জলবায়ু পরিবর্তনের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সাল থেকে পরের দশকগুলোতে বাংলাদেশের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যেতে পারে। চলতি শতাব্দীর তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৪.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত। বাড়বে তাপপ্রবাহের তীব্রতাও।
তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাড়বে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া, শিশুর খর্বকায় হওয়াসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়বে বৃষ্টিপাত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, বন্যা ও ঋতুর আচরণেও। শীতকালে কমে যেতে পারে শৈত্যপ্রবাহের দিনগুলো। সব মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দেশের কৃষি, খাদ্য উৎপাদন ও জীবিকায়।
ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও নরওয়েজিয়ান মিটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ু’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের ভবিষ্যৎ জলবায়ুর এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন। গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে গবেষণা প্রতিবেদনটির ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও নরওয়ের ছয় সদস্যের একটি গবেষকদল গবেষণাটি করেছে।
এর আগে গত বছর যৌথভাবে ‘বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন : ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আবহাওয়ার প্রবণতা এবং পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ’ এবং ‘২০১৬ সালে বাংলাদেশের জলবায়ু’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ও নরওয়ের আবহাওয়া বিভাগ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন বলেন, ‘প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জলবায়ু ভবিষ্যৎ খুবই স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। এই প্রতিবেদন আমাদের এ কথাই মনে করিয়ে দেয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধে ধারাবাহিক প্রতিশ্রুতি অপরিহার্য।
সামনে নির্বাচন। আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো গবেষণার তথ্যগুলোকে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় গুরুত্ব দেবে।’
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে এ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শতাব্দীর শেষে ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়তে পারে। বৃষ্টিপাতের ধরনে বড় পরিবর্তন আসবে।’ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ এরই মধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, টেকসই নগরায়ণ, প্রকৃতিনির্ভর সমাধানসহ গুরুত্বপূর্ণ অভিযোজন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।’
গবেষণার ফলাফল : অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশিদ। গবেষণায় দেশের জলবায়ু সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু পরিবর্তনের বিস্তৃত ও প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে শতাব্দীর শেষে দেশের তাপমাত্রা ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর সঙ্গে তীব্র তাপপ্রবাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, অতিবৃষ্টি এবং জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে।
গবেষণায় ভবিষ্যৎ জলবায়ুর বিষয়ে বোঝার জন্য বাংলাদেশের ১৯৮৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরের আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। ফলাফল উপস্থাপন করা হয়েছে দুই ভাগে। ২০৪১ থেলে ২০৭০ পর্যন্ত মধ্য-শতাব্দী এবং ২০৭১ থেকে ২১০০ শতাব্দীর শেষ ভাগ।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি : গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যদি গ্রিনহাউস গ্যাস কমানো না যায়, তাহলে ২০৪১ থেকে ২০৭০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি বাড়তে পারে। ২১০০ সালের মধ্যে ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে। তাপপ্রবাহ আরো বেড়ে যাবে এবং দেশের পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় সারা বছর প্রচণ্ড গরম থাকতে পারে। তীব্র ও বিস্তৃত তাপপ্রবাহ মৌসুমে ১৫ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন : ভবিষ্যতে বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টির শঙ্কা অনেক বেশি। এ শতাব্দীর শেষে বর্ষার মোট বৃষ্টিপাত গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়তে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টি বাড়ার শঙ্কা সবচেয়ে বেশি। অতিবৃষ্টির ফলে বাড়বে বন্যা ও ভূমিধস।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বন্যা, প্রভাব পড়বে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে : পৃথিবী ক্রমে উষ্ণ হওয়ায় বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে। এতে বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় বন্যা বাড়বে। বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূমির সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ পর্যন্ত স্থায়ীভাবে প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ লাখ মানুষ স্থায়ী বন্যার কারণে জায়গা হারাতে পারে। এ ছাড়া সমুদ্রের পানি বাড়লে লবণাক্ততা বাড়বে। এতে ফসল, মাছ ধরা ও পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
স্বাস্থ্য ও জীবিকায় প্রভাব : গবেষণায় বলা হয়েছে, তীব্র গরমে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো বিভিন্ন তাপজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। শ্রমিকদের কাজ করা কঠিন হবে এবং তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে। গরমের তীব্রতা ১ শতাংশ বাড়লে চাইল্ড স্টান্টিং বা শিশুর খর্বকায় হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে ৫৬ শতাংশ।
এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি : গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন এক দিনে থামানো যাবে না। তাই এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এমনকি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমালেও কিছু পরিবর্তন হবে। কিন্তু গ্রিনহাউস গ্যাস ও দূষণ কমানো না গেলে ভবিষ্যতের ক্ষতি ভয়াবহ হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকি সামাল দিতে দুইভাবে কাজ করতে হবে। একটি হলো, প্রশমন বা দূষণ কমানো। অন্যটি অভিযোজন, অর্থাৎ, ক্ষতি কমাতে প্রস্তুতি নেওয়া। এর মধ্যে রয়েছে বাঁধ, আশ্রয়কেন্দ্র, প্রযুক্তি ব্যবহার ইত্যাদি।