ক্যাডার সার্ভিসের সবচেয়ে বড় ব্যাচ শিক্ষা ক্যাডার। সাড়ে ১৬ হাজার কর্মকর্তার এই ক্যাডারে পদোন্নতি নিয়ে এখন ঘোর অনিশ্চয়তায়। আত্তীকৃত শিক্ষকদের চাকরি-সংক্রান্ত জটিলতা দূর করতে ১৯৮১, ২০০০ এবং ২০১৮ সালে তিনটি পৃথক বিধিমালা জারি করা হয়। এখন এই তিন বিধিতেই ঝুলে আছে ক্যাডার কর্মকর্তাদের ‘বিধি’ বা ভাগ্য। তিনটি বিধি একীভূত না হওয়া, ক্যাডার ও আত্তীকৃত কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা এবং ব্যাচভিত্তিক অসংগতি থাকায় পদোন্নতির পুরো প্রক্রিয়াটিই স্থবির হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই তিন বিধিকে এখন ‘পদোন্নতির গলার কাঁটা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, শিক্ষা ক্যাডারে তিনটি টায়ার বা স্তরে পদোন্নতি হয়। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক। এর সবগুলোই এখন তিন বিধি-জটিলতায় ঝুলে আছে। জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে তিনটি রিট মামলা এবং ৫৪টি পৃথক প্রজ্ঞাপনে আত্তীকৃত ১ হাজার ৪০০ কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। এ কারণে প্রভাষক পদে পদোন্নতি আটকে যায়। এতে দুই স্তরের পদোন্নতিও থমকে গেছে। একই সঙ্গে এ বিধিগুলোর মারপ্যাঁচে ৫ হাজার ৭৫৪ জনকে পদোন্নতির প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও প্রায় ২ হাজার ৩০০ কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে গেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতিসহ অন্যান্য মাপকাঠি ঠিক করতে প্রথম ১৯৮১ বিধিমালা করে সরকার। এই বিধির অধীনে শিক্ষা ক্যাডার গঠন, আত্তীকৃত শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হতো। সেই বিধিতে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হলে বিধিমালা-২০০০ জারি হয়। সময়ের প্রয়োজনে একইভাবে বিধিমালা-২০১৮ জারি করে সরকার, যা ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়। এই তিনটি বিধিতেই আত্তীকৃত শিক্ষক ও কর্মচারীদের ক্যাডার-নন-ক্যাডার বিভাজন, বেতন, পদোন্নতি ও বদলি-সংক্রান্ত নতুন নতুন নিয়ম চালু হয়। কিন্তু সম্প্রতি প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতি দিতে গিয়ে এ-সংক্রান্ত একটি জটিলতা তৈরি হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের কলেজ শাখার তথ্য বলছে, এই জটিলতার মূলে রয়েছে আত্তীকৃত শিক্ষকদের যোগদানের তারিখ নির্ধারণের গুরুতর অসংগতি। নিয়ম অনুযায়ী, আত্তীকৃতদের জন্য প্রজ্ঞাপন জারির তারিখ থেকে তাদের সার্ভিস গণনা হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জারি হওয়া ১৫৪টি প্রজ্ঞাপনে আত্তীকৃতদের নিয়ম ভঙ্গ করে যোগদানের তারিখকে সার্ভিস গণনা দেখানো হয়েছে, যা সরাসরি বিদ্যমান সরকারি চাকরি আইন ও জ্যেষ্ঠতা বিধিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে আত্তীকৃত শিক্ষকরা পুরোনো বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একই সময়ে, এমনকি তাদের আগে পদোন্নতি দাবি করছেন। এই জ্যেষ্ঠতা-ব্যাচের সংঘাত নিয়ে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও উচ্চ আদালতে একাধিক রিট মামলা হয়েছে। বিচারাধীন বিষয়ে পদোন্নতি না দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচারাধীন কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে ‘স্ট্যাটাস কো’ (স্থিতাবস্থা) লঙ্ঘনের ঝুঁকি থাকে। তাই পদোন্নতির মতো বড় সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াতে হচ্ছে প্রশাসনকে। এরপর শিক্ষা ক্যাডার সমিতির নেতারা দফায় দফায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদোন্নতির জটিলতা নিরসনের দাবি জানান। সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর শিক্ষা সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সমিতির শীর্ষ নেতা ও ব্যাচের কর্মকর্তারা। সচিব দ্রুত সময়ের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে আত্তীকৃতদের দাবি অনুযায়ী, পদোন্নতি দিলে শূন্য পদের বিপরীতে কোনো ক্যাডার কর্মকর্তা পদোন্নতি পাবেন না।
সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৪৩(২) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনো কর্মকর্তার জ্যেষ্ঠতা তার চাকরিতে যোগদানের প্রকৃত তারিখ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। একইভাবে সরকারি কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা) বিধিমালা ১৯৮১ অনুযায়ী, পরে যোগদানকারী কেউ আগে যোগদানকারীকে অতিক্রম করতে পারবেন না। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর থেকে জারি হওয়া বিভিন্ন আত্তীকরণ প্রজ্ঞাপনে যোগদানের তারিখকে এমনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে তার সার্ভিস গণনা করতে বাধ্য হয়। এতে পুরোনো ব্যাচের ওপর আত্তীকৃতরা অগ্রাধিকার পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে ওই প্রজ্ঞাপনগুলো চলমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় উভয়পক্ষ একাধিক মামলা করেছে।
রাষ্ট্রপতির আদেশ ৯-এর ১১(১) ধারা অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হওয়ার কথা নিয়োগ বা আত্তীকরণ বা পুনর্বহালের কার্যকর তারিখ অনুসারে। কিন্তু যখন একাধিক ব্যাচের তালিকা হালনাগাদ থাকে না বা পরস্পরবিরোধী হয় তখন পদোন্নতির জন্য যোগ্য তালিকা তৈরি করা যায় না। ন্যূনতম চাকরির মেয়াদ নির্ভুলভাবে গণনা অসম্ভব হয় এবং কোনো ব্যাচ বাদ দিয়ে অন্য ব্যাচকে এগিয়ে দিলে তা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এই জটিলতায় পদোন্নতি বোর্ড সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোথায় স্থাপন করবে, সে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে এই তিনটি বিধিকে নিয়ে এক কম্বাইন বা সমন্বিত বিধি করার আলোচনা হয়েছে। শিক্ষা সচিব তিনটি বিধিকে এক ছাতার নিচে আনর কথা জানিয়েছেন।
৫৭৫৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির প্রস্তাব: শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগেই শিক্ষা ক্যাডারের বড় পদোন্নতির জন্য বিভিন্ন ব্যাচের ৫ হাজার ৭৫৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির জন্য প্রস্তাব করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইছে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই অন্তত দুটি স্তরের প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি চূড়ান্ত করতে। তবে আত্তীকৃতদের মামলার কারণে প্রভাষক পদের সেই পদোন্নতি আটকে যাচ্ছে। ফলে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আটকে গেলে অধ্যাপক পদে পদোন্নতিও আটকে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তথ্যমতে, শিক্ষা ক্যাডারে তিনটি স্তর বা ‘টায়ার’ রয়েছে। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদোন্নতি হয়। এই তিন স্তরের মধ্যে দুটি স্তরের পদোন্নতির জন্য দফায় দফায় বৈঠক চলছে মন্ত্রণালয়ে। এরই মধ্যে সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে ১ হাজার ৩১ জনকে পদোন্নতির জন্য প্রস্তাব করেছে মাউশি। এ পদে ২১তম থেকে ২৩তম বিসিএস ব্যাচকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ১৪তম ব্যাচ থেকে যারা বিভিন্ন সময়ে পদোন্নতি বঞ্চিত ছিলেন, তারাও এবার সুযোগ পেতে পারেন।
এদিকে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে ২ হাজার ৭০০ জনের পদোন্নতির প্রস্তাব পাঠিয়েছে মাউশি। এ ক্ষেত্রে ২৬তম থেকে ৩০তম বিসিএস ব্যাচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে ২ হাজার ২৩ জনকে পদোন্নতির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে ৩৩তম থেকে ৩৫তম ব্যাচকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্তভাবে কতজনকে পদোন্নতি দেওয়া হবে, তা নির্ধারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ধারাবাহিক বৈঠক করছে। কয়েক দফায় বৈঠক করে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে ৩৩তম ও ৩৪তম বিসিএস ব্যাচের যোগ্য ১ হাজার ২০৪ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সমিতি দাবি জানিয়েছে ৩৫তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়ার।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলছেন, নির্বাচনী তপশিল ঘোষণার আগেই শিক্ষা ক্যাডারের বড় পদোন্নতি দিতে কাজ শুরু করেছেন। এর মধ্যে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অধ্যাপক পদে পদোন্নতির প্রাথমিক ধাপ ডিপিসির (বিভাগীয় পদোন্নতি সভা) দুটি বৈঠক করা হয়েছে। শিগগির সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি নিয়ে ডিপিসি বৈঠক শুরু হবে। সব মিলিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে নির্বাচনের আগেই এই ক্যাডারের বড় একটি পদোন্নতি দিতে পারে। তিন স্তরে সম্ভব না হলেও অন্তত প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক এবং সহযোগী থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির কাজ শেষ করতে চায় মন্ত্রণালয়। সেজন্য প্রশাসনিক বিভিন্ন প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক পদে বিপুল পদোন্নতির আভাস: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ শাখার তথ্যমতে, সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য ১ হাজার ৩১ জনকে প্রস্তাব করা হয়েছে। এ পদের জন্য পদোন্নতিযোগ্য ব্যাচ হলো ২১তম থেকে ২৩তম বিসিএস। গত ১৩ ও ১৫ নভেম্বর এ-সংক্রান্ত দুটি ডিপিসি সভা হয়েছে, যেখানে শূন্য পদের তালিকা এবং যোগ্য প্রার্থীদের এসিআর (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) যাচাই-বাছাই করা হয়েছে।
মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডারের সবচেয়ে বড় ব্যাচ ১৪তম ও ১৬তম বিসিএসের প্রায় সবাই অবসরে চলে যাবেন। ফলে অধ্যাপক পদে ব্যাপক পদ শূন্য হবে। সারা দেশে ৬০০-এরও বেশি কলেজ অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের পদ ছাড়াও মাউশির বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ, এনসিটিবি, নায়েম, ১১টি শিক্ষা বোর্ড, দেশের আঞ্চলিক অফিস, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ, কারিগরি, প্রাথমিক এবং মাদ্রাসা অধিদপ্তরে বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষা ক্যাডার থেকে অধ্যাপক পদে ডেপুটেশন (প্রেষণ) পদায়ন করা হয়। সব মিলিয়ে ১ হাজার ২০০ গুরুত্বপূর্ণ পদে শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপকদের পদায়ন করা হয়। এর সঙ্গে কলেজগুলোতে বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক পদ তো রয়েছেই। এই বিশাল সংখ্যক পদে যোগ্য কর্মকর্তার প্রয়োজন মেটাতে দ্রুততম সময়ে পদোন্নতি দেওয়া জরুরি বলে মনে করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় চাইছে অধ্যাপক পদে শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি দিতে। আর মাউশি চাইছে ১ হাজার ৩১ জন সবাইকে পদোন্নতি দিতে।
জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক বি এম আব্দুল হান্নান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি সর্বোচ্চসংখ্যক পদে পদোন্নতি দেওয়ার। সেজন্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যত ধরনের চেষ্টা দরকার সবটাই করা হচ্ছে। আশা করছি, মন্ত্রণালয় দ্রুত সময়ের মধ্যে পদোন্নতির সুখবর দেবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) মজিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘দুটি স্তরে পদোন্নতির জন্য কাজ চলছে। মামলা-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে আইন শাখা ‘না’ মতামত দিয়েছে। এখন উচ্চ আদালত কী আদেশ দেন, সেদিকে তাকিয়ে আছি। না হয় ভিন্ন কোনো পস্থায় করা যায় কি না, সেটিও বিবেচনায় রয়েছে।’