Image description
জাতীয় সংসদ নির্বাচন । বড় জোট গঠনের পথে বিএনপি । সমমনা আট দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা জামায়াতের । বিএনপি ও জামায়াত দুই দলের সঙ্গে আলোচনায় এনসিপি । চারটি জোট গঠনের তৎপরতা ।

অন্তর্বর্তী সরকার আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুযায়ী আগামী মাসের (ডিসেম্বর) প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার আর অল্প সময় বাকি থাকলেও ভোটের জোট গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো জট লেগে গেছে। বর্তমানে আসন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে চলছে শেষ মুহূর্তের দর-কষাকষি।

 
কিন্তু নিজস্ব মার্কায় নির্বাচনসহ নানা সমীকরণে বড় দলগুলো এখনো জোট বা আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে পারেনি।

 

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে অন্তত চারটি জোট গঠনের তৎপরতা চলছে। এবার কোনো দলের এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। দেশের বৃহৎ দল বিএনপি তাদের সমমনা দল নিয়ে একটি বড় জোট গঠন করতে পারে। পাশাপাশি কয়েকটি দলের সঙ্গে আসন সমঝোতাও হতে পারে।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা ইসলামী দলগুলোর পৃথক জোট হতে পারে। কয়েকটি দল নিয়ে এনসিপিরও যেমন জোট গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে, আবার তারা অন্য কোনো জোটের সঙ্গেও যেতে পারে। এনসিপি, বিএনপি ও জামায়াত এই দুই দলের সঙ্গেই আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।

আবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতৃত্বেও বাম ও সমমনা দলগুলোর একটি জোট গঠনের তৎপরতা আছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা যারা যুগপৎ আন্দোলন করেছি, তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। নেগোসিয়েশনও চলছে। এটা আমাদের পার্টিতেও আলোচনা হতে হবে। তবে এখনো তফসিলের বাকি আছে।

আমার কাছে মনে হয়, আরো সময় আছে। আমাদের আলোচনা চূড়ান্ত হওয়ার পর সবাইকে জানাব। যথাসময়েই জানাব।

গত ৩ নভেম্বর দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি ২৩৭ আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। যদিও পরে মাদারীপুর-১ আসনের মনোনয়ন স্থগিত করা হয়েছে। এ ঘোষণার পরই বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নেমে পড়েছেন। ফলে দেশজুড়ে নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। তবে প্রার্থী ঘোষণা না করা কিছু আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীরা যেমন প্রচারণা চালাচ্ছেন, একই সঙ্গে জোটের প্রার্থীরাও প্রচারণা চালাচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রচারণায় এগিয়ে আছেন বিএনপির প্রার্থীরা, যা নিয়ে শরিক দলের প্রার্থীরা চিন্তিত। আর ওই সব আসনে বিএনপি বা জোটের প্রার্থী কে হবেন তা নিয়ে ভোটাররাও রয়েছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে।

জানা গেছে, বিএনপির সঙ্গে শরিক দলগুলোর আসন বণ্টনে দলের পক্ষ থেকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে আগে থেকেই সমন্বয় করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর দাবি, বিএনপি ৬৪টি আসন ফাঁকা রাখলেও যেসব দল যুগপৎ আন্দোলনে ছিল, তাদের জন্য ২০ থেকে ২২টি আসন ছাড়া হতে পারে। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে সমঝোতা হলে ৪০টির মতো আসন ছাড় দিতে পারে বিএনপি। শরিক দলগুলোর কাউকে কাউকে প্রার্থিতার বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হলেও এখনো নাম ঘোষণা করা হয়নি। আর বিএনপি যদি সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে শরিক দলের শীর্ষ কোনো নেতা বাদ পড়লে তাঁকে সরকারের সুবিধাজনক কোনো পদে বসানো হতে পারে।

অন্যদিকে জামায়াত কয়েক মাস আগেই ৩০০ নির্বাচনী আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এই প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণাও চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় সম্ভাব্যদের মধ্য থেকে অনেকে বাদ পড়বেন। জামায়াত সমমনা আটটি ইসলামী দলের সঙ্গে আন্দোলন করছে। নির্বাচনে তাদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করবে বলেও জানিয়েছে দলটি। এর বাইরেও তাদের সঙ্গে আরো কিছু সমমনা দলের জোট গঠনে আলোচনা চলছে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের কালের কণ্ঠকে বলেন, একসঙ্গে আন্দোলনের মাঠে থাকা আট দলের সঙ্গে আমরা আসন সমঝোতা করব। তাদের পাশাপাশি আরো কিছু সমমনা দলের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ বা তফসিলের কাছাকাছি সময়ে এই আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হতে পারে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, ছয়টি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণফোরামসহ আরো দু-একটি দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে পারে বিএনপি।

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জোটের ব্যাপারে আগে থেকেই আলোচনা চলছে। গত সোমবারও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা জানিয়েছি, আসন বণ্টনের বিষয়টি অতি দ্রুত সমাধান হওয়া দরকার। আমাদের তাঁরা জানিয়েছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে অল্প সময়ে তারা জোটের বিষয়টি ফাইনাল করবেন।

জামায়াত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন করছে। তাদের সঙ্গে আসন সমঝোতা করবে জামায়াত। পাশাপাশি আরো কয়েকটি দলের সঙ্গেও আলোচনা করছে জামায়াত। 

আরেকটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, এনসিপি যদি বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে জোট না করে তবে শেষ পর্যন্ত নিজেরাই জোট গঠন করতে পারে। এনসিপি জোট গঠনের ক্ষেত্রে এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ আরো কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা করছে।

সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ একটি সংকটকালীন মুহূর্তে রয়েছে। সেই জায়গায় বিএনপি ও জামায়াত যদি সংস্কার প্রক্রিয়াগুলো নিয়ে এক জায়গায় আসে এবং তা ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করবেএই প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে বিএনপি অথবা জামায়াত যে কারো সঙ্গে আমাদের জোট হতে পারে। তবে বিচার ও সংস্কারের প্রাথমিক শর্ত যদি পূরণ না হয়, তাহলে তাদের কারো সঙ্গে জোটে যাব না। অন্য এক অনুষ্ঠানে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে একটি সংস্কার জোট হবে। জোট গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।

নির্বাচনের আগে বাম ধারার সব দল ও সংগঠনকে নিয়ে একটি জোট গঠনে তৎপর রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। এই জোটে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ছয় দলবাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, সমাজতান্ত্রিক পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ থাকছে। এর বাইরে আদিবাসী সংগঠন, দলিত সংগঠন ও নাগরিক সংগঠনগুলোকে জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আমরা বৃহত্তম রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছি। যারা মুক্তিযুদ্ধকে মানে তারা এই ফ্রন্টে থাকবে। এই লক্ষ্যে আমরা বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, আদিবাসী (ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠী), দলিত, নাগরিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করছি। তবে আগামী ২৫ নভেম্বর আমরা সিপিবির পক্ষ থেকে প্রার্থী ঘোষণা করব।

সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ বলছেন, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন বাধ্যতামূলকের বিষয়টি বিভিন্ন রাজনৈতিক জোটের শরিক দলগুলোর কাছে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অনেক প্রার্থীই একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান বা শীর্ষ নেতা হলেও এলাকায় তাঁদের তেমন জনপ্রিয়তা নেই। আবার নামে চিনলেও তাঁর দলের প্রতীক কেউ চেনে না। ফলে ওই দলের জন্য জোট থেকে আসন ছাড়লেও নিজস্ব প্রতীকে তাঁর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, যা ওই জোটের জন্যও চিন্তার বিষয়।

বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান কালের কণ্ঠকে বলেন, জোটে থাকা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জন্য প্রতীক একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কিছু দলের প্রতীক সাধারণ মানুষ চেনে না। তবে আমার দলের প্রতীক আনারস, যা সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত। তার পরও আমরা এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষে এ ব্যাপারে আমরা নির্বাচন কমিশনের একটা পজিটিভ রেজাল্ট পাব বলে আশা করছি ।