Image description

নির্বাচনি পরিবেশে এবার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে থাকবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত সত‍্য-মিথ‍্যা মিলিয়ে তথ‍্য। ফেসবুক, টুইটারের পাশাপাশি ইউটিউবে প্রচারিত অসমর্থিত সূত্রের নানা ভিডিও। বড় প্রশ্ন আকারে সামনে এসেছে, প্রতিনিয়ত সত‍্যের মোড়কে মিথ‍্যা তথ্য প্রচারকে কীভাবে মোকাবিলা করবেন নাগরিকরা। যারা ফ‍্যাক্ট চেক করছেন তারা বলছেন, ডিসইনফরমেশনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় পুরোটা ফ‍্যাক্ট চেকের আওতায় আনা সম্ভব না। অপতথ‍্যের বেশিরভাগই মতামত, ঘৃণা প্রচারের বিষয় হওয়ায় সেসবের পদ্ধতিগত ফ‍্যাক্ট চেক হয়ও না। এ ধরনের তথ‍্য বিশ্বাস করা ও ছড়ানোর বিষয়ে দরকার সচেতনতা।

বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের আইসিটি বিভাগ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যার মধ‍্যে আছে সাইবার মনিটরিং সেল গঠন, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধ উদ্যোগ এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ।

ইউটিউবের নানা ভিডিওর ঝলক

কিছু ইউটিউব চ্যানেল নিজেদের ‘নিউজ চ্যানেল’ হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা দলীয় প্রচারণা চালায় বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য ছড়ায়। এসবে অ্যালগরিদমের অপব্যবহার করা হয়। যেসব ভিডিও দ্রুত ভিউ পায়, ইউটিউবের অ্যালগরিদম সেগুলো আরও বেশি মানুষকে দেখায়। ফলে ভুয়া তথ্য দ্রুত ভাইরাল হয়। সেসবে সতর্ক থাকা জরুরি।

মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক সুদীপ্ত সালাম দুটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে এআই এবং ইউটিউবকেন্দ্রিক অপসাংবাদিকতাকে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, ‘এখনই আমরা দেখছি এআই দিয়ে তৈরি নানা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে সেসব ভিডিওর তথ্য সত্য হিসেবে ধরেও নিচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে সেসব ভিডিও যাচাই করাও সম্ভব হচ্ছে না। এই সিনারিও দিনদিন বাড়ছে, সামনেও বাড়বে। অন্যদিকে ভিউ ব্যবসার নামে গজিয়ে ওঠা ইউটিউব-ফেসবুককেন্দ্রিক অপসাংবাদিকতার প্লাটফর্মগুলো অভিশাপের মতো কাজ করছে, করবে। এসব প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার কোনও তোয়াক্কা করা হয় না। যে কারও হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ক্যামেরা, বুম ও মোবাইল ফোন। তারা জানেও না সাংবাদিকতা কী। শুধু জানে, তাকে এমন কিছু ধারণ করতে হবে, যা মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হবে।’

সুদীপ্ত সালাম আরও বলেন, ‘টেক্সটের চেয়ে ভিডিও কয়েক গুণ বেশি গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রভাব ফেলে। সাংবাদিক হলে ভিডিওর মাধ্যমে দ্রুত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ছড়িয়ে পড়বে, অসাংবাদিক হলে দ্রুত অসত্য, উদ্দেশ্যমূলক ও বানোয়াট কন্টেন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে।’

কী করবো, কী করবো না

বর্তমান বাংলাদেশে প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ‍্যমে নানা রকম তথ‍্য ছড়িয়ে পড়ছে। মূল ধারার মিডিয়ার কাছাকাছি নামে ফেক পেজ, ইউটিউবে ফেক চ্যানেল বানিয়ে স‍্যাটায়ার ও অপতথ‍্যের পোস্টের ছড়াছড়ি শঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এই যেকেনও একটা তথ‍্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজে থেকে সেটা যাচাই না করে শেয়ার করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সে বিষয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এখনকার সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া তথ্য খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে, আর সেটা মানুষকে বিভ্রান্ত করে, ভয় তৈরি করে, কখনও ব্যক্তিগত সম্মান বা নিরাপত্তারও ক্ষতি করে। তাই তথ্য দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে শেয়ার না করে একটু থেমে যাচাই করা জরুরি। উৎস কোথা থেকে এসেছে, তারিখ পুরোনো কী নতুন, একই তথ্য একাধিক বিশ্বস্ত মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে কি না—এই তিনটা জিনিস চেক করলেই অনেক ভুল এড়ানো যায়। আমাদের সবার দায়িত্ব হলো—আবেগে নয়, যাচাই করে কথা বলা। কারণ আমরা যেন তথ্যের বাহক হই, আতঙ্কের নয়।’

ভয়েস ওভার দিয়ে, ভিডিও বানিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়- কোনটা মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, আর কোনটা না, সেটাও আজকাল বের করা কঠিন হয়ে যায় উল্লেখ করে আব্দুল্লা আল মামুন বলেন, ‘এই সময়টাতে যখন এআই এসে গেছে, তখন অনলাইন ব‍্যবহারকারীরা তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। একদল বুঝতে পারে না কোনটা ফেক, একদল যা দেখে তাই বিশ্বাস করে, আরেকদল সত‍্য মিথ‍্যা নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকে। যেহেতু এখন ভিডিও ও ছবিকে অল্টার করা যায়, ফলে শঙ্কা বেশি। সতর্ক থাকা ছাড়া উপায় নেই। সেক্ষেত্রে, ‘থিঙ্ক’ পদ্ধতি ব‍্যবহারের কথা বলা হয়। কিছু শেয়ার করার আগে দেখুন সেটা ট্রু (সত‍্য), হেল্পফুল (কারোর কাজে লাগবে কিনা), ইনফরমেটিভ (তথ‍্যবহুল কিনা), নেগেটিভিটি (সত‍্য হলেও শেয়ার করার জন‍্য সময়োপযোগী কিনা), কাইন্ডনেস (উপস্থাপনের ধরনে) আছে কিনা। মূল কথা বলো, যেটা বুঝি না সেটা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।’

আইসিটি বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের উদ‍্যোগ বিষয়ে বলেন, ‘আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে এর আগে বিভিন্ন স্তরের সাংবাদিক এবং পুরো দেশে ছড়িয়ে থাকা যে তথ্য অফিসাররা আছেন, তাদের জন্য ডিজিটাল ভেরিফিকেশনের কাজ করা হয়েছে। যাতে তারা মিসইনফরমেশন ডিসইনফরমেশন আইডেন্টিফাই এবং এই ধরনের এক্সটেন্ডেড কাজগুলো করতে পারেন। সেগুলোর জন্য তাদের বেশ আগে থেকেই আইসিটি মিনিস্ট্রি হতে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। অনেকজনকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, এবং একইসঙ্গে নির্বাচনকে সামনে রেখে কীভাবে এই মিসইনফরমেশন ডিপ ফেক, এগুলো আইডেন্টিফাই করতে জনগণকে কীভাবে হেল্প করা যায় এবং সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় সরাসরি এবং খুব গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।’

সরকারি স্বাধীন ফ‍্যাক্ট চেকিং ও করণীয়

ফ্যাক্ট চেক সংস্থা তথ্য যাচাই করে নিরপেক্ষ রায় দেয় — কোনটি সত্য, কোনটি বিকৃত, কোনটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এতে জনসাধারণের আস্থা তৈরি হয় এবং গুজবের প্রভাব কমে। সরকারের ছত্রছায়ায় বা স্বাধীনভাবে এখন বেশকিছু প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ফ‍্যাক্ট চেকিংয়ের কাজ করছে। কিন্তু যে পরিমাণ অপতথ‍্য ছড়াচ্ছে সে পরিমাণ তথ‍্য যাচাইয়ের সক্ষমতা কি তৈরি হয়েছে? ডিজিটালি রাইট এর ব‍্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী মনে করেন অনলাইনে যে মিসইনফরমোশন বা ডিজইনফরমেশন আছে, এখন যারা ফ‍্যাক্ট চেক করছেন তারা তার সব যাচাই ক্ষমতা রাখেন না। তার দুটি কারণ আছে। প্রথমত, লোকবল কম, ডিসইনফরমেশন বেশি। দ্বিতীয়ত, পদ্ধতিগতভাবে গণমাধ‍্যম ফ‍্যাক্ট চেক করতে পারে না। কেননা, যেটা যাচাই করতে চাইবেন সেখানে যাচাইযোগ‍্য মিথ‍্যা তথ‍্য থাকতে হবে। অনলাইনে যা কিছু ছড়ায়, সেখানে গুজব, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ঘৃণা থাকে, তথ‍্য থাকে না। সেখানে মতামত থাকে, মত যাচাই করা যায় না। তিনি বলেন, ‘মিডিয়ার কাজ আগে ছিল তথ‍্য দেওয়া, এখন তাকে কোন তথ‍্য মিথ‍্যা সেটাও বলতে হয়। তাকে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে ওবং এখানে বিনিয়োগ করতে হবে। তবে কেবল যাচাই বা অনুসন্ধান করে এই ডিসইনফরমেশন ঠেকানো যাবে না, সোশ‍্যাল মিডিয়া প্ল‍্যাটফর্মগুলোরও দায়িত্ব আছে। তাদের এগুলো শনাক্ত করতে হবে এবং অধিকার লঙ্ঘন না করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দিনশেষে জরুরি হলো- মানুষের সচেতন হওয়া। কোনটা কতটুকু নিতে হবে সেটার বোধ তৈরি হওয়াটাই মিসইনফরমোশন ঠেকানোর পদ্ধতি। এটা গড়ে তুলতে হলে আমাদের শিক্ষা ব‍্যবস্থায় ক্রিটিক‍্যাল থিংকিং যুক্ত করতে হবে।’