জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র মতপার্থক্যে জটিল অবস্থায় পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। দলগুলো বিভক্ত থাকায় সামনে জাতীয় নির্বাচনসহ বড় সিদ্ধান্তগুলো নিতে বেকায়দায় পড়েছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ মতামতের জন্য অপেক্ষায় আছেন প্রধান উপদেষ্টা। চলতি সপ্তাহে ঐকমত্য না হলে সরকার নিজ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত জানাবে এমনটি আগে বলা হয়েছিল। নির্ধারিত সময় শেষে সরকার এমন সিদ্ধান্ত দেবে কিনা, দিলে কেমন সিদ্ধান্ত দেবে, সরকারের সিদ্ধান্ত দলগুলো গ্রহণ করবে কিনা এমন নানা প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, দলগুলোর ভিন্ন অবস্থান থাকার কারণে সরকারের তরফে সিদ্ধান্ত জানানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়কে আদেশ জারির বিষয়ে প্রস্তুতি নিতেও বলা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের দিন গণভোটে অনড়। জামায়াতসহ সমমনা ৮ দল নভেম্বরে গণভোট করার দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টাকে। ওদিকে, এনসিপি বলছে, গণভোট চাইলে নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠিত হতে পারে। গণভোট ইস্যুতে যেখানে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়ও ইতি টানা যায়নি। সেখানে সরকার আবার দলগুলোকে বসতে বলে নিজেই সংকট সৃষ্টি করছেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
গত ২৭শে অক্টোবর জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারকে দুটি প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এরপরই গণভোট ও নোট অব ডিসেন্ট ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বিপরীত অবস্থান নেয়। এই অচলাবস্থার মধ্যে ৩রা নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে দলগুলোকে সাতদিনের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত দিতে অনুরোধ করে সরকার। ছয়দিন কেটে গেলেও দলগুলোর কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানালেও বিএনপি জানিয়েছে জামায়াতের ডাকে তারা সাড়া দেবে না। প্রধান উপদেষ্টা আলোচনার উদ্যোগ নিলে তা ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করা হবে।
সূত্র বলছে, দলগুলোর সিদ্ধান্তের অপেক্ষার সঙ্গে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির প্রস্তুতিও এগিয়ে চলছে। উপদেষ্টা পরিষদের সর্বশেষ বৈঠকেও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয় এবং আইন মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলা হয়।
সূত্র জানায়, কমিশনের দ্বিতীয় প্রস্তাব অনুযায়ী, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ সরকার জারি করতে পারে। এক্ষেত্রে ২৭০ দিনের সময়সীমার পরিবর্তে যতদিন লাগে, ততদিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কারের কাজ শেষ করার বিধান রাখা হতে পারে। একইসঙ্গে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া বাকি সকল প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট উল্লেখ থাকতে পারে বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিল পাস করবে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঐকমত্য না এলে সপ্তাহের শেষ দিকে সব দলকে নিয়ে আবারো বৈঠকের কথা ভাবছেন প্রধান উপদেষ্টা। কারণ, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এদিকে সমঝোতা চেষ্টার অংশ হিসেবে জামায়াতের নায়েবে আমীর গত বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপি’র মহাসচিবকে ফোন করলেও বিএনপি’র ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। দলটির নেতারা মনে করছেন গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে একটি রাজনৈতিক দল আলোচনার আহ্বান জানাতে পারে না। প্রধান উপদেষ্টা এই উদ্যোগ নিতে পারেন।
ইতিমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় দল, এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে বৈঠক করেছে। বৈঠকে দলগুলোর নেতারা জুলাই সনদ বাস্তবায়নে অভিন্ন অবস্থানে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
গতকাল এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, জুলাই সনদে সবকিছুই এসেছে। শাসনতান্ত্রিক বিষয়গুলো প্রমিন্যান্টলি এসেছে, যেটা পত্রিকায় আপনারা রিফ্লেকশন দেখেছেন। আর সবাই যদি ভাবেন যে, আমরা নয় মাসে কুইক ফিক্স করে ফেলবো, সেটাও তো হয় না। এই ডায়ালগটা হয়তো এমন হতে পারে, ইলেকশনের পরে আবার নতুন করে ডায়ালগ হতে পারে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে তা বাস্তবায়ন হবে। যেগুলোতে ঐকমত্য হয়নি তা জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ঐকমত্যের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই।
গণভোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই সরকার সংবিধানের প্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছে। সেই সংবিধানে গণভোটের কিছু নেই। যদি গণভোট করতে হয় তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুসারে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে এসে সংসদে পাস করার পরে, সেই বিষয়গুলো গণভোটে যেতে পারে। এসব করে অনেকে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই সনদের আদেশ প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে দিতে হবে। জুলাই জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) বলে কিছু থাকবে না।
তিনি বলেন, জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট বলে কিছু থাকবে না। যা ঐকমত্য হয়েছে, তার বাকিটা ঠিক করবে জনগণ। জনগণ যদি বলে, তাহলে সেগুলো বাস্তবায়িত হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, সমঝোতা এবং সনদ বাস্তবায়নে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার জন্য এখনো কোনো কিছু জানানো হয়নি। তিনি বলেন, সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের তৈরি করা এই অনৈক্য। সমাধানও তাদের হাতে। যেসব ব্যাপারে সবার ঐকমত্য আছে সরকার সেসব বিষয় ভিত্তি ধরে এগোবে।
তিনি বলেন, গণভোটের বিষয়ে দু’একটি দল ছাড়া অধিকাংশ দলই নির্বাচনের দিন গণভোট করার কথা বলেছে। এর বাইরে সরকারের যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকার নির্বাচনের দিনই গণভোটের বিষয়ে বলবে। বাকি প্রশ্নগুলো নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। সরকার এ পথে হাঁটলে সহজেই সমাধান বেরিয়ে আসবে। রাজপথ দখলের মধ্যদিয়ে ঐকমত্য সমাধান করা যাবে না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যতটুকু সংকট আছে সেটা মোকাবিলা করা সম্ভব।
ওদিকে নির্বাচনের আগে গণভোটসহ ৫ দাবিতে মাঠের কর্মসূচি পালন করছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ ৮টি দল। এসব দল আগামী মঙ্গলবার রাজধানীতে মহাসমাবেশ ডেকেছে।