ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদন: অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দীর্ঘ আট বছর। পৃথিবীর আলো-বাতাসের প্রবাহ যেখানে থমকে যায়। একজন বন্দীকে তেলাপোকা, ইঁদুর আর মশার সঙ্গে বসবাস করতে হয়। দিন-রাতের পার্থক্য নির্ণয় করা যায় না। বন্দীর একমাত্র কামনা থাকে মৃত্যু। এভাবেই হতাশার কথা জানাচ্ছিলেন পতিত সরকারের আমলে গুম হওয়া মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান)। তিনি বলেন, ‘সেখানে আমার কিছুই করার ছিল না, প্রতিটি রাতেই কারারক্ষীদের আসার প্রতীক্ষা করতাম যে তারা এসে আমাকে নিয়ে যাবে।’ অনুবাদ: মানবজমিন
জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে আরমান। ২০১৬ সালে গুম হওয়ার আগ পর্যন্ত পতিত স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার লক্ষ্যে পরিণত হওয়া তার পিতার আইনজীবী হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। সে সময় বহু মানুষকে বিশেষ এক কারাগারে বন্দী করা হতো। যার নাম আয়নাঘর। সেখানে বন্দীদের হাত ও চোখ বেঁধে রাখা হতো। কয়েকশত বন্দীর মধ্যে আরমানও ছিলেন। তিনি ভয়াবহ এই বন্দীদশা থেকে গত বছরের ৬ আগস্ট মুক্তি পান। আরমান বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আমাকে মেরে ফেলা হবে। আমি দোয়া কালাম পড়ছিলাম। কিন্তু আমাকে উন্মুক্ত করে একটি মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়।’
তার এই মুক্তির ঠিক মাস খানেক আগে বাংলাদেশে ঘটে যায় এক নজিরবিহীন ইতিহাস। সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। যা একসময় রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে এই অভ্যুত্থানকে বর্ষা বিপ্লব বা মুনসুন রেভ্যুলেশন আখ্যা দেয়া হয়েছে। গত বছরের ওই অভ্যুত্থানে পতন হয় দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা নেত্রী শেখ হাসিনার। দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারত চলে যান। আরমান মুক্তির পর যখন এ ঘটনা জানতে পারেন তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, আমরা ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেয়েছি।’
কার্যত হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের পরিকল্পনা করে ছাত্র নেতারা। তারা বাংলাদেশের পরবর্তী নেতা হিসেব শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বেছে নেন। পরে তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। হাসিনার দখলদারিত্বের রাজনীতির অবসানসহ সামাজিক, বিচারিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে হওয়া গুম, খুন ও শত শত কোটি পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন তারা। তবে এখনকার পরিস্থিতি হলো ত্রয়োদশ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এই ক্ষেত্রে ১৭ কোটি জনগণের দেশটির ঐক্য ধরে রাখতে সংগ্রাম করছেন ড. ইউনূস।
এদিকে বিশ্বাস হারাচ্ছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত-এর সম্ভাবনা। কেননা বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুরানো সেই পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিই ফের প্রভাব বিস্তার করছে। সমাজে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দানা বেঁধে উঠছে। কট্টর ইসলামপন্থীদের উত্থানের শঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে আওয়ামী লীগ বলে বেড়াচ্ছে যে, তাদের কিছু নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ড. ইউনূসের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে সকল দলের মধ্যে সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা ড. ইউনূসের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন নানাবিধ কারণে গণঅভ্যুত্থানকে অনেকেই একটি মিথ্যা ভোর হিসেবে বিশ্বাস করা শুরু করেছেন। ঢাকার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির বলেন, ‘আমাদের জাতীয় ঐক্যের একটি বিরল মুহূর্ত ছিল, যা এখন পুরোপুরি নেই হয়ে গেছে। আমরা পুরোপুরি বিভক্ত, আমরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছি।’
তবে হাসিনার ওপর এখনও জনগণের প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা উজ্জ্বল। হাসিনার ফাঁসির দাবির ব্যানারে ভরে আছে রাজধানীর সড়কগুলো। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ভয়াবহ গণহত্যার মূলহোতা মনে করা হয় তাকে। ব্যানারগুলোতে হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তির মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের মতে, অভ্যুত্থানে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে কয়েক ডজন শিশুও আছে। বেশিরভাগই নিহত হয়েছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে নতুন প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘গণহত্যার’ নির্দেশ, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, উস্কানি এবং সহায়তার জন্য ৭৮ বছর বয়সী হাসিনার মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে।’’ তিনি বলেন, ‘এগুলো সবচেয়ে গুরুতর ও জঘন্যতম অপরাধ।’ প্রধান প্রসিকিউটর বলেন, ‘ঢাকা ভারতের কাছে প্রত্যর্পণের অনুরোধ করেছে, কিন্তু নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক সাড়া দেয়া হয়নি।’ দিল্লি ও ঢাকার কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন হাসিনাকে ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী তারা অপরাধটিকে রাজনৈতিক বলে মনে করলে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রাখে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পিতা মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তার ৮০ বছর বয়সী মা খালেদা জিয়াও কয়েক দশক ধরে বিএনপির দায়িত্বে ছিলেন। পরে তা ছেলের কাছে হস্তান্তর করেন।
ছাত্রনেতাদের অন্যতম নাহিদ ইসলাম। তার নেতৃত্বে তরুণদের নতুন দল গঠিত হয়েছে। যার নাম এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টি। তিনি মনে করেন দেশের রাজনীতিতে স্বাভাবিক ধারা ফিরে আসা উচিত। নাহিদ বিশ্বাস করেন, ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ধারা, দুর্নীতি এবং জনগণকে মূল্যায়ন করে না এমন রাজনীতির বিরুদ্ধেই গত বছর গণঅভ্যুত্থান করেছে এ দেশের মানুষ। তারা যখন রাস্তায় নেমেছে তারা শুধু একটি সরকারের উৎখাত চায়নি বরং পুরনো রাজনীতির বিলোপের মাধ্যমে আইনের শাসন, ন্যায্যতা, জবাবদিহিতা এবং নিজেদের মর্যাদার দাবি জানিয়েছে। তার ধারণা, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু নাও হতে পারে।
এদিকে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে আগামীতে যেই সরকার গঠন করুক, তাকে চীনের সঙ্গে চলমান ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক বজায় এবং ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েনের সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ শাখা গার্মেন্টস খাত পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।