জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দেশ জুড়ে নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ১৩ই নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হবে। এই রায়কে ঘিরে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টায় আছেন গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের গুজব ও অপপ্রচার। গণসমাবেশ ঘটিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, লকডাউন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলার আশঙ্কা এবং যানবাহনে অগ্নিসংযোগের প্রচারণাও চালিয়েছে দলটি। আশঙ্কা আরও উস্কে দিয়েছে গত ৫ই নভেম্বর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের দেয়া একটি ভিডিও বার্তা। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের এই নেতা লকডাউন’-এর ঘোষণা দিয়ে বলেন, ১৩ই নভেম্বরকে সামনে রেখে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হোন। ঢাকায় আমরা ১৩ই নভেম্বর লকডাউন দিয়েছি। সকাল-সন্ধ্যা লকডাউন। ১০ থেকে ১২ই নভেম্বর দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল এবং ১৩ই নভেম্বর যেন রাজধানী ঢাকা শহর আমাদের দখলে থাকে, জয় বাংলার দখলে থাকে।
গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গোপনে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন আওয়ামী নেতাকর্মীরা। নানকের ভিডিও প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ ঢাকা শহর এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঝটিকা মিছিল করেছে। তাদের টার্গেট শেখ হাসিনার রায় ঘোষণায় বাধা সৃষ্টি এবং জাতীয় নির্বাচন বানচাল করা। এই লক্ষ্যে সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় জড়ো হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে, নানকের এই বার্তা দ্রুতই দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে এক ধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এ নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতার এমন বার্তা একেবারে উড়িয়ে না দিয়েও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তৎপরতা শুরু করেছেন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। পুলিশ বলছে, নাশকতা এড়াতে ১০ই নভেম্বর থেকে ঢাকার প্রবেশপথ, আবাসিক হোটেল, মেস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলে তল্লাশি ও বিভিন্ন অভিযান শুরু করা হবে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হবে। এর বাইরে সরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। চেকপোস্ট ও টহল বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের তালিকা ধরে ধরে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক নেতাকর্মীদের নজরদারিতেও রাখা হয়েছে। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, বিচ্ছিন্নভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পরিচয় গোপন রেখে অবস্থান করছেন। সুযোগ পেলেই তারা সংগঠিত হয়ে ঝটিকা মিছিল করবে। তবে খুব বড়ভাবে একত্রিত হয়ে কোনো ধরনের নাশকতা করার সুযোগ পাবে না। কারণ সারা দেশেই পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা ও সেনা সদস্যরা সতর্ক রয়েছেন।
সাইবার নিয়ে কাজ করেন পুলিশের এমন কর্মকর্তারা বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কোন কোন আইডি থেকে গুজব ছড়ানো হচ্ছে সেসব আইডি শনাক্ত করা হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ আইডি ও পেজ দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হওয়ার কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলটির শীর্ষ নেত্রীর রায় ঘিরে তারা কিছু কর্মসূচি দিতেই পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সতর্ক থাকতে হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ মানবজমিনকে বলেন, কোনো ধরনের হুমকি-ধমকি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। পতিত আওয়ামী লীগের সাবেক এই শীর্ষ নেত্রীর মামলার রায়কে ঘিরে কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা নেই। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
সুপ্রিম কোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল কোর্ট সিকিউরিটি বিভাগের ডিসি মো. জসিম উদ্দীন মানবজমিনকে বলেন, রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট হুমকির তথ্য কিংবা কোনো নিরাপত্তার শঙ্কা নেই। তবে, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ সতর্ক থাকবে। এ ছাড়াও সাদা পোশাকেও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত থাকবে।
র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, এগুলো উড়ো খবর। কনফার্ম কিছু না। গুজবে কান দেয়ার কোনো সুযোগ নাই। দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করে বলতে চাই র্যাবের গোয়েন্দা টিম ও সাইবার মনিটরিং টিম সবসময় তৎপর রয়েছে। এ ধরনের উড়ো খবর যখন আসে তখন আমাদের টিম আরও বেশি তৎপর হয়ে কাজ শুরু করে। এই ইস্যুকে ঘিরেও মনিটরিং শুরু হয়েছে। যেকোনো ধরনের তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছে আমাদের টিম।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, বিভিন্ন পেজ ও আইডি থেকে এই ধরনের তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এগুলো দেশের বাইরে থেকে পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে তথ্য যাই হোক আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবো। কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটির কোনো কার্যক্রম করার সুযোগ নাই। আমরা আইনি ব্যবস্থা নেবো। আগেও আমরা অনেক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করেছি। আর চলমান ইস্যু নিয়ে আমরা তৎপরতা বাড়িয়েছি। আমাদের সাইবার টিমও এ নিয়ে কাজ করছে।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা রেঞ্জের প্রতিটি জেলায় নির্দেশনা দিয়েছি। আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী কোনো ধরনের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তারা আগেও অনেক ধরনের হুমকি দিয়েছে, এখনো দিয়ে যাচ্ছে। ১৩ই নভেম্বর ঘিরে তারা মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে আলোচনায় আসতে যাচ্ছে। আমরা কোনো ভাবেই তাদের এসব হুমকি-ধমকি ভয় পাই না। তবে আমরা সতর্ক আছি। কোনো ধরনের কিছু করতে চাইলে পুলিশ কঠোর হাতে তাদের প্রতিহত করবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) রেজাউল করিম মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কোনো বিশৃঙ্খলা করার সুযোগ নাই। আওয়ামী লীগকে কোনো ভাবে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না। কোনো মিছিল ও সভা করতে চাইলেও প্রতিহত করা হবে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ এই দলটির নেতাকর্মীর সন্ধান পেলে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে সব জেলার পুলিশ সুপারদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা বরদাশত করা হবে না।