ডেঙ্গুতে থামছেই না মৃত্যু। চলতি বছরের আগস্ট থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে, দিন যত বাড়ে রোগটিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুতে একের পর এক রেকর্ড ভাঙতে থাকে। চলতি নভেম্বর মাসের ২ তারিখ থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫ দিনে মশাবাহিত রোগটিতে মারা গেছেন ২৯ জন ডেঙ্গুরোগী। একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৫,৫১৩ জন রোগী। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের শুরুতেই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা নিয়ে সতর্কবার্তা জানিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। কিন্তু বিষয়টি তেমনভাবে আমলে নেয়নি সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো। তাদের মতে, শুরু থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে এত প্রাণ ঝরতো না।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে ১ হাজার ৩৪ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একইসঙ্গে সারা দেশে ৯০১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ছাড়পত্র পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৮৮ জন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৭৬ হাজার ২৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় তিনজন, উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় একজন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে একজন মারা গেছেন। একদিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৩৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৩৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০৩ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ১৮৮ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২০০ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৭১ জন, খুলনা বিভাগে ৫৫ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে), ময়মনসিংহ বিভাগে ৬৬ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে), রাজশাহী বিভাগে ৭৯ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে), রংপুর বিভাগে ৩৩ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) এবং সিলেট বিভাগে ৫ জন (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
আজও একটি ছোট্ট পতঙ্গের কাছে পরাজিত ॥ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ২৬ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো নীতিনির্ধারকদের গবেষণাভিত্তিক পরামর্শ উপেক্ষা করা। আমি একাধিকবার বৈজ্ঞানিক মডেল প্রস্তাব করেছি, কিন্তু দুঃখজনকভাবে তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ কারণেই আজও আমরা একটি ছোট্ট পতঙ্গ এডিস মশার কাছে পরাজিত হচ্ছি।
তিনি বলেন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এসব হাসপাতালে অন্তত দুইজন চিকিৎসককে ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনে রোগীকে অন্যত্র পাঠানো না হয়। কারণ এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের সময়ই অনেক রোগীর অবস্থা মারাত্মক হয়ে ওঠে। এই রেফারেল বিলম্ব কমাতে প্রশাসনিকভাবে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মৃত্যু বিশ্লেষণ টিমের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করতে হবে বলে মনে করেন এই কীটতত্ত্ববিদ। ডেঙ্গু চিকিৎসায় দ্রুত শনাক্তকরণ, হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি, চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ ও মৃত্যু বিশ্লেষণ, এই চারটি উপাদান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করলে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে মনে করেন তিনি।
প্রতিরোধে করণীয় ॥ ড. কবিরুল বাশার বলেন, বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, গবেষক, গণমাধ্যম ও জনগণÑ সবাইকে একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস, দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ এবং হাসপাতালভিত্তিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এই তিনটি পদক্ষেপ যদি নীতি স্তরে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে বাংলাদেশেও ডেঙ্গু মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, এডিস মশা আজ আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ব্যর্থতাকে সফলতায় রূপ দিতে হলে এখনই সময় দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা এবং জনগণের সম্মিলিত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার। ডেঙ্গু আর কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি এখন জাতীয় সংকট। এর সমাধানে সমন্বিত জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ছাড়া বিকল্প নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, এ বছর ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে অক্টোবরে, সংখ্যাটি ৮০ জন। আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২২ হাজার ৫২০ জন। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১৫ হাজার ৮৬৬ জন। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৫৭৫ জন। এর আগে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয় এবং ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।