Image description

‘সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে/ আমরা বাঙালি বাস করি সেই বঞ্ছিত ভূমি বঙ্গে।/ বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি,/ আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরি মাথায় নাচি।’

ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই মাধুর্যময় কবিতার প্রতি শব্দে প্রতিধ্বনি শুনতে পাই যে, অঞ্চলের মানুষের জীবনালেখ্যের, তা যেন এই সুন্দরবন এলাকার। জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকার এমন অদম্য প্রয়াস পৃথিবীর খুব কম এলাকাতেই দেখতে পাওয়া যায়। আজও সুন্দরবন এক বিষ্ময়ের জগত্। নদনদী, খালবিল, গাছপালা অধ্যুষিত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যভূমি, যার সর্বত্র বিপদ ওত্ পেতে আছে। ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির। অসংখ্য প্রজাতির গাছপালার অরণ্যে বাঘ, হরিণ, বুনো শুয়োর, বিষাক্ত সাপ, বেজি থেকে শুরু করে কত যে প্রাণীর বসবাস—সে খবর রাখেন কম মানুষই। লোনা মাটির ভূমি সুন্দরবনের অপরিমিত সৌন্দর্য মুগ্ধ করে মানুষকে। কিন্তু প্রাণবৈচিত্র্যের আধার সেই সুন্দরবন আজ প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণে বিপর্যস্ত।

বাতাসে মিশে থাকা প্লাস্টিকের গন্ধ, নদী-খালের পানিতে ভেসে চলা মোড়ক এবং গাছপালার সঙ্গে আটকে থাকা ফাইবার—সব মিলিয়ে বনজ ও জলজ সম্পদে ভরপুর সুন্দরবনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে প্লাস্টিক বর্জ্য। সুন্দরবনের মাটি ও পানিতে উদ্বেগজনকহারে মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক (৫ মিলিমিটারের কম দৈর্ঘ্যের প্লাস্টিক কণা)। এই প্লাস্টিক দূষণ জলজ ও স্থলপ্রাণীর পাশাপাশি গাছের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রকৃতির এই শৃঙ্খলিত বিশাল বনাঞ্চল মানুষের ফেলা বর্জ্যে এখন ধুঁকছে। সুন্দরবনের নিস্তব্ধ পরিবেশে নাগরিক জীবনের ময়লা-আবর্জনার উত্কট গন্ধ  ভেসে বেড়াচ্ছে।

সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। পর্যটন মৌসুমে পর্যটকরা সুন্দরবনের নদী-খালে চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট, প্লাস্টিকের পানির বোতল, পলিথিন, ওয়ান টাইম প্লেট-গ্লাস, চকোলেটের খোসা ফেলে যান। এ সব প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর জোয়ার-ভাটায় ১০-১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বনের অভ্যন্তরে ঢুকে যায়। এ সব বর্জ্য সুন্দরবনের গাছের শ্বাসমূলে ঢুকে জড়িয়ে থাকে। এতে প্রাণশক্তি হারিয়ে গাছ মরে যায়। এছাড়া সুন্দরবনের পশুর, ঢাকি, শিবসা নদীর ভেতর দিয়ে খুলনা থেকে কয়রা, মদিনাবাদ, জোড়সিংসহ বিভিন্ন রুটে লঞ্চ চলাচল করে। এসব লঞ্চের যাত্রীরা বিভিন্ন প্লাস্টিক বর্জ্য নদীতে ফেলেন। তাছাড়া লঞ্চের জ্বালানি তেল নদী-খালের পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে। এছাড়া সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোর মানুষেরা বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উত্সব পালনের সময় প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস ব্যবহার করার পর বাড়ির পাশের খালে ফেলে দেয়। জোয়ার-ভাটার সময় সেগুলো বনের মধ্যে ভেসে গিয়ে গাছের শ্বাসমূলের ক্ষতি করে।

সুন্দরবনকে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ফুসফুস। এটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলকে রক্ষা করে, কার্বন শোষণ করে, অক্সিজেন উত্পাদন করে। এর ওপর নির্ভর করে কোটি মানুষের খাদ্য, জীবিকা ও পরিবেশগত ভারসাম্য। কিন্তু দ্রুত বাড়তে থাকা প্লাস্টিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ এই ফুসফুসকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দিচ্ছে। যদি এখনই কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে সুন্দরবনের নাম ভবিষ্যতে শুধু বইয়ের পাতায় থাকবে, বাস্তবে নয়।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য এমন ভয়ংকর যে ৪০০ বছরেও মাটির সঙ্গে মেশে না। জোয়ার-ভাটার সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য সুন্দরবনের গাছের শ্বাসমূলে ঢুকে একসময় সেই গাছ মরে যায়। তবে আমাদের পক্ষ থেকে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে পূর্ব সুন্দরবনের অভয়ারণ্য কটকা, কচিখালী ও দুবলারচর থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। প্রতি মাসেই এই অভিযান চলবে। কিন্তু বর্তমানে জেলেদের জালে ব্যবহূত ফ্লো (জালে ব্যবহূত প্লাস্টিকের তৈরি এক ধরনের বল) সব থেকে ক্ষতিকর। এই ফ্লো’র ৬০ শতাংশই বন ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি করে। সুন্দরবনের কচিখালী ও দুবলার নদী-খালে এই জাল ব্যবহূত হচ্ছে। অচিরেই এগুলো উচ্ছেদ করা হবে।

সুন্দরবনের বন ও নদীর সম্পদের ওপর ৩৫ লক্ষাধিক মানুষ নির্ভরশীল। কেউ মাছ ধরেন, কেউ চিংড়ি বা কাঁকড়া সংগ্রহ করেন, আবার কেউ মধু সংগ্রহ করেন।  কিন্তু প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাছ ও কাঁকড়ার সংখ্যা দ্রুত কমছে। স্থানীয় জেলেরা বলছেন, আগে নদীতে নামলেই প্রচুর মাছ পাওয়া যেত, এখন মাছ কমে গেছে, আর যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলোতেও রোগ দেখা দিচ্ছে। তাদের ভয়, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ চিত্র:খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবির) এক গবেষণায় সুন্দরবনের প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় বনের ছয়টি স্থানের পানি ও মাটি পরীক্ষা করা হয়। ঐ গবেষণায় সুন্দরবনের প্রতি লিটার পানিতে ২.২২ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া যায়। প্রতি কেজি মাটিতে এই পরিমাণ গড়ে ৭৩৪ কণা। অন্য এক গবেষণা তথ্য বলছে, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর স্রোতে প্রতি বছর প্রায় চার মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে জমা হয়। সাগরের ঢেউ ও নদীর জোয়ারের সঙ্গে সেই প্লাস্টিক সুন্দরবনের পানিতে ভেসে আসে। বনের মধ্য দিয়ে চলাচলরত ভারী নৌযানের বর্জ্য, মাছ ধরার নেটজাল, কৃষিজ আবর্জনা, শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য ও পলিথিন মিলিয়ে বিশাল এই সবুজ বনাঞ্চল এখন হুমকির মুখে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, প্লাস্টিক দূষণ, অবৈধ তত্পরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

‘মাইক্রোপ্লাস্টিক পলিউশন লোড ইন সুন্দরবন ডেল্টা অব বে অব বেঙ্গল’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা পৃথিবীর শীর্ষ দশ প্লাস্টিক বহনকারী নদীর তালিকায় রয়েছে। এই নদীগুলো বছরে ৭২ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক বঙ্গোপসাগরে ফেলে। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৬০ সালের মধ্যে ভারত থেকে ৫২ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং বাংলাদেশ থেকে ৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন প্লাস্টিক বঙ্গোপসাগরে জমবে। এর ফলে ভবিষ্যতে সুন্দরবনের মতো সংবেদনশীল ম্যানগ্রোভ ইকোসিস্টেমে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ‘প্লাস্টিক বর্জ্য এক সময় সূর্যের তাপে মাইক্রোপ্লাস্টিক বর্জ্যে পরিণত হয়। এটি সুন্দরবনের জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্লাস্টিক বর্জ্য বনের গাছ ও চারার শ্বাসমূলে ঢুকে যাবার কারণে সেগুলো মারা যায়। এছাড়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার কারণে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিশেষ করে মাছ। এই মাছ খেয়ে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দেখেছি, সুন্দরবনের একটি বাঘ প্লাস্টিক খেয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে বাঘটি তার স্বাভাবিক খাবার খেতে পারত না। পরবর্তী সময়ে বাঘটির পাকস্থলী অস্ত্রোপচার করে দেখা যায় সে প্লাস্টিক খেয়েছিল। এভাবে সুন্দরবনের পশুপাখি এবং নদীর জলজ প্রাণী প্লাস্টিক বর্জ্য খেয়ে রোগাক্রান্ত ও পরবর্তীতে মারা যাচ্ছে। যা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।’

অধ্যাপক ড. ওয়াসিউল ইসলাম সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সুন্দরবন সংলগ্ন মানুষ এবং পর্যটকদের প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে জোরালোভাবে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী প্লাস্টিক বর্জ্য সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক শুধু প্রাণীর দেহে জমছে না, তা খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। কেবল নদীতীর নয়, প্লাস্টিক পৌঁছে গেছে প্রাণীকুলের দেহেও। মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া, কচ্ছপ, এমনকি হাঙরের দেহেও মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে। গবেষণা বলছে, একেকটি প্রাণীর শরীরে গড়ে শূন্য দশমিক ৫৬ থেকে ৬ দশমিক ১৬টি কণা জমছে। ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা প্রথমে প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে নেয়, তারপর ছোট মাছের দেহে, পরে বড় মাছের দেহে প্রবেশ করে এবং সর্বশেষ মানুষের খাদ্যশৃঙ্খলেও পৌঁছে যাচ্ছে।’ 

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে যাতে প্লাস্টিক বর্জ্যসহ কোনো ধরনের পরিবেশ দূষণ না হয়—সে ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর সচেষ্ট রয়েছে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। বিশেষ করে সুন্দরবনের ট্যুর অপারেটর ও লঞ্চ মালিকদের সচেতন করা হচ্ছে। রাস মেলাকে সামনে রেখে সুন্দরবনের দুই বলার চরে প্লাস্টিক বর্জ্য সংক্রান্ত সচেতনতামূলক সভা করা হবে। যাতে সুন্দরবনে প্লাস্টিক বর্জ্যসহ কোনো ধরনের দূষণ না ঘটে।’

দূষণ মোকাবিলায় করণীয়:সুন্দরবন সংশ্লিষ্টদের মতে, প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় কেবল আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও টেকসই দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ। এছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আরো দক্ষ ও কার্যকরভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টুয়াস) সভাপতি মো. মইনুল ইসলাম জমাদ্দার বলেন, বর্তমানে সুন্দরবনে প্লাস্টিক বর্জ্যসহ যে ময়লা-আবর্জনা জমা হয়, তার মাত্র ৫ শতাংশ পর্যটকদের হতে পারে। বাকি ৯৫ শতাংশই সুন্দরবনের প্রান্তসীমার উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামের মানুষের ব্যবহূত ময়লা-আবর্জনা ও পলিথিন। ঐসব জনপদের মানুষের ব্যবহূত বর্জ্য নদী-খালে ভাসতে ভাসতে সুন্দরবনে গিয়ে জমা হয়। এছাড়া সুন্দরবনের দুবলারচরের শুঁটকিপল্লির ময়লা-আবর্জনার সবই যায় সুন্দরবনে। এছাড়া মোংলা পৌরসভা ও পোর্টের ময়লা-আবর্জনা ও প্লাস্টিক বর্জ্যের বড় একটি অংশ সুন্দরবনে জমা হয়। যা বনের পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মূলত সুন্দরবনে এই ময়লা-আবর্জনার প্রধান কারণ হচ্ছে, সুন্দরবন সংলগ্ন কোথাও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেই। এর ফলে ডাস্টবিনের ময়লাও পশু-পাখির মাধ্যমে আবারও সুন্দরবনে গিয়ে পড়ে বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে।

তার মতে, সুন্দরবনের প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে আলোচনাসভা, পথসভা, নাটক, পটগান, জারিগান, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা যেতে পারে। এছাড়া সুন্দরবনসংলগ্ন মোংলা ও খুলনায় প্লাস্টিকসহ বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের মতে, বাংলাদেশের গর্ব বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে স্কুল-কলেজে পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া ও রেডিওতে নিয়মিত প্রচারাভিযান চালাতে হবে। মিডিয়ায় পরিবেশবান্ধব বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে কর্মশালা, র‍্যালি ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান আয়োজনের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো যেতে পারে। প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিরোধে বিশেষ করে সরকারি নীতিনির্ধারণ, বেসরকারি সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ ও নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি—এ তিনটি স্তরেই সমান্তরালভাবে কাজ করতে হবে। একটি সমন্বিত ও অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিই পারে সুন্দরবনকে প্লাস্টিক দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে।

প্রসঙ্গত, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। কমতে কমতে বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার; যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির মোট ৫১ ভাগ। সংরক্ষিত এ বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইট ঘোষণা করে। যেখানে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি। এছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি। সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইটের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্ জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার; যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এ জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ ১ হাজার ৬০৩ দশমিক ২ বর্গকিলোমিটার। এ জলভাগে ছোটবড় ৪৫০টি নদনদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার। এরই মধ্যে সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্যমহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, ২ প্রজাতির গন্ডার ও  এক প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।