Image description
কথিত গোয়েন্দা রিপোর্টের দোহাই দিয়ে আটকে দেয়া ও হয়রানি করা হচ্ছে দেশের অনেক সম্মানিত নাগরিককে

যা ইচ্ছে তাই চলছে দেশের ইমিগ্রেশনে। কাদের নিয়ন্ত্রণে ইমিগ্রেশন, আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই বা কি করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন দেশের সাধারণ মানুষের। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় নির্যাতনে শিকার বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বড় ব্যবসায়ী, পত্রিকার সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নানা পেশার মানুষকে বিদেশে যাওয়ার সময় দেশের ইমিগ্রেশনে আটকে দেয়া হচ্ছে, করা হচ্ছে হয়রানি। ‘আপনার বিরুদ্ধে ওই গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট রয়েছে’ প্রায় সবার ক্ষেত্রে একই ধরনের এমন তথ্য দিচ্ছেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা।

বলা হচ্ছে, গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে আপনার পাসপোর্ট ব্লক করা হয়েছে। একই সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়েও রাখা হচ্ছে দেশের অনেক সম্মানিত নাগরিকদের। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে ব্যাংকক যাওয়ার জন্য হযরত শাহজালাল (রা:) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছালে বিএনপি নেতা ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলনকে ইমিগ্রেশন বিভাগ যেতে বাধা দেয়। ফলে তিনি যেতে পারেননি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী সরকারের পতনের ১৪ মাস পরেও পুলিশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট এসবি’র ইমিগ্রেশনের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ শেখ হাসিনার আস্থাভাজন পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে রয়েছে। কৌশলে ইমিগ্রেশন দিয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ খুনি পুলিশ কর্মকর্তাদের ভারতসহ বিদেশ পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে ইমিগ্রেশনের আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাই। অন্যদিকে বিদেশগামী ও বিদেশ ফেরত যাত্রীদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নাম ভাঙ্গিয়ে হয়রানিও করছেন তারা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। না হয় কোনো কারণ ছাড়াই কথিত গোয়েন্দা রিপোর্টের নাম করে হয়রানি চলতেই থাকবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সরকারি কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, গত সপ্তাহে তিনি দেশের বাইরে যান। কিন্তু হযরত শাহজালাল (রা:) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পর তার পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাকে জানানো হয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার ক্লিয়ারেন্স লাগবে। এক ঘণ্টা পরে তাকে পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয়। তিনি বলেন, আমি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বঞ্চিত কর্মকর্তা এবং সরকারের অনুমতি নিয়ে বিদেশে যাচ্ছি এরপরেও আমাকে হয়রানি করা হয়। এটি পরিকল্পিত হয়রানি বলে তিনি মন্তব্য করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইনকিলাবকে বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য। কিন্তু অক্টোবর মাসে আবারো তার বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু হযরত শাহজালাল (রা:) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে যাওয়ার পর ইমিগ্রেশন থেকে জানানো হয় তার পাসপোর্ট ব্লক করা হয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তার পাসপোর্ট ব্লক করা হয়। কিন্তু কোনো গোয়েন্দা সংস্থা বা কি রিপোর্টের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হলো তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ইমিগ্রেশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তারা এক পর্যায়ে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন। কিন্তু তিনি আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে পারেননি। পরে বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন। ওই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন যে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে একাধিক। এমনকি আমাকে বেশ কিছু দিন গুম ঘরেও কাটাতে হয়েছে। এরপরেও আমার পাসপোর্ট ব্লক করা হয় গোয়েন্দা রিপোর্টের নাম করে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।

সরকারের একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের পর পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সে অবস্থা থেকে ফিরতে অনেক দিন সময় লেগেছে। এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ বাহিনীতে হাসিনার দোসররা এখনো বহাল আছে। ইতোমধ্যে হাসিনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, খুনি পুলিশ কর্মকর্তারা ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী কিছুই জানেন না! তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই! সাধারণ মানুষের প্রশ্ন তাহলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বক্স কী করছেন? তাদের কাজ কী? অভিযোগ রয়েছে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা ও পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি কাহার আখন্দ হাসিনার ঘনিষ্ট ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কাহার আখন্দের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা এবং পিলখানা হত্যা মামলার তদন্ত করে মনগড়া চার্জশীট দেয়ার অভিযোগসহ নানা অভিযোগ রয়েছেন। আর এর বিনিময়ে কাহার আখন্দ পেয়েছিলেন শত শত কোটি টাকা ও একের পর এক পদোন্নতি।

ভুক্তভোগী যাত্রীরা বলছেন, ইমিগ্রেশন দেশের একটি স্পর্শকাতর ও অতিগুরুত্বপূর্ণ পুলিশের ইউনিট। এখানে একজন বিদেশগামী যাত্রীর সমস্যা সমাধান করার ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক ছুটির বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না। ইমিগ্রেশনে ২৪ ঘণ্টা সার্ভিসের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় দেশে অনেক বিদেশগামী যাত্রী শুধু বিদেশ যাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। বরং বড় অংকের টাকার ক্ষতির মধ্যেও পড়তে হচ্ছে ওই যাত্রীকে। এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইমিগ্রেশনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা শুক্রবার ইনকিলাবকে বলেন, আমরা যারা ইমিগ্রেশনে কর্মরত রয়েছি তারা শুধু আদেশ পালন করি। আমাদের পক্ষে কোনো যাত্রীকে ফেরত পাঠানো বা যেতে দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার সুযোগ নেই। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হয় কম্পিউটারে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সক্রিয় রয়েছে মানব পাচারে জড়িত বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের সাথে আওয়ামীপন্থ’ী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ দীর্ঘদিনের। বিদেশগামী যাত্রীদের হয়রানির পাশাপাশি বিমানবন্দরের বিভিন্ন বিভাগের ধান্ধাবাজির অভিযোগও রয়েছে বিগত সরকারের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তারা (সাবেক আ’লীগ ক্যাডার কর্মকর্তা) আবার সক্রিয় হলে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের শত শত শহীদের আত্মা যেমন শান্তি পাবে না, তেমনি দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের সুনাম ক্ষুণœ হবে।