নির্বাচন আয়োজনের সকল কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে, এখন চলছে সর্বশেষ প্রস্তুতি। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে সারা দেশের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও শেষ হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আন্তঃমন্ত্রণালয়ে ৩১ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন স্টকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। স্বৈরাচারী শাসন পতনের পর দীর্ঘ ১৬ বছরের বেশি সময় এমন স্বচ্ছ নির্বাচনের অপেক্ষায় বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সারাবিশ্ব। বিগত তিনটি নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা কমনওয়েথ বা আন্তর্জাতিক কোনো পর্যবেক্ষক তেমন কোনো সাড়া দেয়নি। তবে দীর্ঘ ১৭ বছর পর (২০০৮ সালের নির্বাচন) প্রতিনিধিদল প্রেরণে সরকারের সঙ্গে আশা ব্যক্ত করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কমনওয়েলথ।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হয় তা পর্যবেক্ষণের জন্য ১৫০-২০০ জনের একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যা ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর এবারই প্রথম। এছাড়াও গত ২৬ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর কমনওয়েলথের একটি প্রতিনিধিদলও পর্যবেক্ষক পাঠানোর কথা জানিয়েছেন। গত ২৮ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার এ ঘোষণা দেন। ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের একটি বড় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করছে ইইউ যা ২০০৮ সালের পর এবারই প্রথম। বৈঠকে রাষ্ট্রদূত জানান, ইইউ পর্যবেক্ষক দল এখনো চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা হয়নি, তবে এটি ১৫০ থেকে ২০০ সদস্যের মধ্যে থাকতে পারে। কিছু প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রায় ছয় সপ্তাহ আগে এবং অন্যরা ভোটের এক সপ্তাহ আগে যোগ দেবেন। নির্বাচনে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের দূতাবাস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পর্যবেক্ষণ করে ইতিবাচক প্রচারণা করলে সে নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এছাড়াও ২০০৮ সাল থেকে ৫ বছরের জন্য দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা নিয়োগ দেয়া হয়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে দেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগের জন্য ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালা-২০২৫’ জারি করেছে ইসি। এই নীতিমালা শুধু দেশীয় পর্যবেক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে জানানো হয়। গত ৩০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পর্যবেক্ষক নীতিমালা জারির বিষয়ে জানান। নীতিমালা অনুযায়ী, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের মূল উদ্দেশ্য হলোÑ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা জানা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়িয়ে ভোটারের আস্থা বৃদ্ধি করা। পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে নিবন্ধনের জন্য আবেদনের যোগ্যতা হলোÑ বেসরকারি সংস্থা যারা গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে এবং যাদের নিবন্ধিত গঠনতন্ত্রে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নাগরিকদের মধ্যে তথ্য প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণের অঙ্গীকার রয়েছে, কেবল তারাই আবেদন করতে পারবে। যেসব কারণে অযোগ্য বলে গণ্য হবে সংস্থা-নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তি বা যারা নিবন্ধন লাভের জন্য আবেদনকৃত সময়ের মধ্যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী, এমন কেউ যদি সংস্থার প্রধান নির্বাহী বা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হন, তবে সেই সংস্থা নিবন্ধন পাবে না। আবেদনকারী সংস্থাকে অবশ্যই হলফনামা দিতে হবে যে তাদের প্রধান নির্বাহী বা পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্য রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট নন। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে হুবহু মিল বা কাছাকাছি নাম ব্যবহার করা হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে, এমন প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন পাওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে আন্তর্জাতিক/আঞ্চলিক সংস্থার ক্ষেত্রে লিখিত অনাপত্তিপত্র দাখিল করলে বিবেচনা করা হতে পারে। সেইসঙ্গে পূর্বে যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাদের নিবন্ধন দেওয়া হবে না।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে একজন ব্যক্তির লিখিত যোগ্যতা থাকতে হবেÑ ১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। ২. বয়স ২১ (একুশ) বছর বা তদূর্ধ্ব হতে হবে। ৩. ন্যূনতম উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। ৪. কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হতে পারবে না। ৫. কোনো রাজনৈতিক দল বা দলের অঙ্গসংগঠন বা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারবে না। ৬. রাজনৈতিক দল বা এর অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কেউ পর্যবেক্ষক হতে পারবেন না। ৭. পর্যবেক্ষক মোতায়েনের একক ইউনিট হবে উপজেলা/ মেট্রোপলিটন থানা অথবা সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা। ৮. পর্যবেক্ষকদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা বা ভোটার হওয়া চলবে না। ৯. নিবন্ধিত পর্যবেক্ষক সংস্থা নির্বাচনের আগের দিন, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচনের পরের দিন অর্থাৎ ৩ (তিন) দিনের জন্য পর্যবেক্ষক মোতায়েন করতে পারবে। তবে নীতিমালা লঙ্ঘন বা রাষ্ট্র বা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে কমিশন সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ১০ দিনের মধ্যে লিখিত জবাব চেয়ে নোটিশ পাঠাবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে বা শুনানিতে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কমিশন সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। এক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
গত ২৭ জুলাই পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন আবেদন আহ্বান করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাটি। এক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী আবেদন জমা দেওয়ার জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল, যা শেষ হয়েছে গত ১০ আগস্ট। গত ১৭ জুলাই দেশীয় পর্যবেক্ষক নীতিমালা-২০২৫ জারি করা হয়। বাতিল করা হয় ২০২৩ সালের নীতিমালা। পাশাপাশি ওই সময়ের সংস্থাগুলোর নিবন্ধনও বাতিল হয়েছে। নতুন নীতিমালা জারি করার পর ৭৩টি সংস্থা আবেদন করে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ৭৩ পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনে কারো দাবি-আপত্তি থাকলে তা জানতে ১৫ কার্যদিবস সময় দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তবে নির্ধারিত সময় পার হলেও একটি পর্যবেক্ষক সংস্থা নিয়ে কেউ দাবি-আপত্তি জানায়নি। এতে এবার দাবি-আপত্তি শূন্য। এর মধ্যেই কমিশন পুনরায় নীতিমালা প্রকাশ করেছে।