Image description

ডেঙ্গুর মৌসুম প্রায় শেষ। তবুও প্রায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গু জ্বরে কাতরাচ্ছে মানুষ। এখনো প্রতিদিন ৫শ’ থেকে এক হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মারাও যাচ্ছেন গড়ে ৩ থেকে ৪ জন। বর্ষা মৌসুম শুরু থেকেই দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। বিশেষ করে এবার ঢাকার বাইরে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু রোগী এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গুতে মৃত্যু সর্বোচ্চ। তবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ অনুযায়ী এডিস মশা নিধনে কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়- এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এবার নভেম্বরেও ডেঙ্গুর দাপট থাকবে দেশে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও ৫০৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ২৭৮ জন। এরমধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে ১৩৪ জন মারা গেছেন এবং উত্তর সিটিতে ৪১ জন রয়েছেন। বরিশাল বিভাগে মারা গেছেন ৪০ জন। গত ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬৯ হাজার ৮৬২ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের মধ্যে ৬২ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৮ শতাংশ নারী। অক্টোবরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি  রোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ৫২০ জন এবং মারা যান ৮০ জন। সেপ্টেম্বরে এই সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৮৬৬ জন এবং মারা যান ৭৬ জন, আগস্টে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৪৯৬ জন এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেন ৩৯ জন।

ডেঙ্গু বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশারের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, এবার নভেম্বরেও ডেঙ্গুর দাপট থাকবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব তাই বলছে। তিনি বলেন, এখনো থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর মশার ঘনত্ব বেশি। আবার এ বছর রোগীও বেশি। তাদের গবেষণায়  দেখা গেছে, আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই তিন মাস ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ ঝুঁকির সময় হিসেবে ধরা হয়। এবছর আক্রান্ত ও মৃত্যু তাই প্রমাণ করে। তিনি আরও বলেন, এডিস মশার ব্রিডিং সোর্স ধ্বংস করতে হবে। যেসব জায়গায় জনবলের ঘাটতি আছে তা মিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে। জনসাধারণকে নিজের বাড়ি, বাড়ির আঙ্গিনায় পানি যাতে না জমে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)-এর আহ্বায়ক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ এক প্রবন্ধে  ডেঙ্গু সম্পর্কে বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর কেবল মৌসুমি বা শহুরে রোগ নয়, এর বিস্তার ঘটেছে সারা দেশে এবং প্রায় সব মৌসুমেই। 
সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝেমধ্যে ফগার মেশিনে কীটনাশক ছিটিয়ে দায় সারছে। অথচ গবেষণা বলছে, এ ধরনের ফগিংয়ে আসলে ডেঙ্গুর মূল বাহক এডিস মশা দমন হয় না।

তিনি আরও বলেন, হাসপাতালগুলোয় শয্যাসংকট, ডাক্তার-নার্সের ওপর অতিরিক্ত চাপ ও পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহের অভাব ডেঙ্গুর চিকিৎসাব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তুলছে। প্রশাসনিকভাবে দায়সারা কাজ হচ্ছে, কিন্তু সুসংগঠিত ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা অনুপস্থিত। ডেঙ্গু শুধু একটি রোগ নয়, এটি আমাদের অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার প্রতিচ্ছবি। আমরা যদি এখনো হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে মৃত্যু আরও বাড়বে, পরিবারগুলো ভাঙবে, সমাজ ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়বে। এখনো সময় আছে আমাদের বিবেক ও চেতনা জাগ্রত করার। আমরা সাধারণ নাগরিকেরাও দায় এড়াতে পারি না। 

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কমাতে হলে এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়ার তাগিদ দেন তিনি। স্থানীয় সরকারকে নেতৃত্ব দিতে হবে ওয়ার্ডভিত্তিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও কার্যকর মশানিধন কর্মসূচির মাধ্যমে। মশানিধন কর্মসূচি সফল করতে হলে এর পুরো ইকোসিস্টেমকে সম্পূর্ণ কার্যকর করে তুলতে হবে। এ জন্য কিছু মৌলিক দিক নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সম্মিলিত উদ্যোগে, নিজ নিজ এলাকার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা ইউনিয়ন পরিষদের) নেতৃত্বে এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি টেকসই ও কার্যকর সামাজিক আন্দোলন গড়ে  তোলার কথা বলেন এই বিশেষজ্ঞ।