রাজধানীবাসীর সহজ ও আরামদায়ক যাত্রার অন্যতম মাধ্যম মেট্রোরেল। কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকেই হরহামেশাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে মেট্রোরেল চলাচল। যা যাত্রীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সূত্র ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেলের তৎকালীন এমডি ছিলেন এমএএন ছিদ্দিক। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তাড়াহুড়ো করে চালু করেন মেট্রোরেল। তড়িঘড়ি করে কাজটি করায় নির্মাণ ত্রুটিও রয়ে যায়। যার ফলস্বরূপ দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মেট্রোরেল পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ না দিয়ে, নন টেকনিক্যাল কর্মকর্তাদের বসানো হয়েছে। এতে অবকাঠামোর সুরক্ষাসহ যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান- ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
সূত্র জানিয়েছে, মেট্রোরেলের গুণগত মান ঠিকঠাক মতো বজায় রেখে কাজ শেষ করার জন্য আরও যথেষ্ট সময় দিতে হতো। অন্য প্রকল্পে যেখানে বলা হয়- তাড়াতাড়ি করার চেয়ে আগে গুণগত মান নিশ্চিত করা হোক। সেখানে তখনকার এমডি বলেন, আমি তাড়াতাড়ি করতে চাই। তাই এখানে টার্গেটকে এগিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। তখনকার এমডি এমএএন ছিদ্দিক নিজের ক্রেডিট জাহির করার জন্য ২০১৯ সালে ঘোষণা দেন এই বছরের মধ্যে যেভাবে হোক এটা উদ্বোধন করতে হবে। তখন পর্যাপ্ত লোকবলও ছিল না। ২০২১-২২ সালের আগে যা করা সম্ভব ছিল না, তিনি চেয়েছেন কাজটি ওই বছরই সম্পন্ন করে ফেলা হোক। সূত্র থেকে আরও জানানো হয়েছে, মেট্রোরেলের লাইন-৬ এর কাজ শেষে বুঝে নেয়ার মতো পরিপক্ব কর্মকর্তা ছিল না তখন। যারা মেট্রোরেল বুঝে নিয়েছে অনেক দুর্বল অবস্থায় বা অরক্ষিত অবস্থায় নিয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র। কোনো টেকনিক্যাল লোক ছিল না তখন।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শামসুল হক মানবজমিনকে বলেন, একটি লোক মারা যাওয়ার পর বিয়ারিংয়ের ইস্যু আসছে। এরপরও আরও অনেক কিছুই আছে। মেট্রোরেলে অপারেশনে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অপারেশনাল দুর্বলতা তো আছেই, আরেকটি হচ্ছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা। আরও অনেক সমস্যা হবে দেখা যাবে। অপারেশনাল সমস্যাগুলোতে অনেক ধকল যাবে। এই অবকাঠামো ডিএমটিসিএল মেইনটেইন করার জন্য না আছে লোকবল, না আছে লজিস্টিক সাপোর্ট। নিরাপদ যাত্রীসেবা দিতে হলে অপারেশন অ্যান্ড মেনটেইন্যান্সকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে। মেট্রোরেল চালু হয়েছে একটি দুর্বল অবকাঠামো দিয়ে। যথাযথ মান নিয়ন্ত্রিত ছিল না। ফলে তার ফলাফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে।
সরকারের একটি বিভাগের সচিব মানবজমিনকে বলেন, ২০২২ সাল থেকে মেট্রোরেলের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী যে পরিমাণ ট্রায়াল রান চালানোর দরকার ছিল সে পরিমাণ ট্রায়াল চালানো হয়নি, এটা সত্য। কিন্তু একদমই তড়িঘড়ি করে যে মেট্রোরেল চালু করা হয়েছে বিষয়টি এমনও না। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট লিমিটেডের বর্তমান এমডি ফারুক আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী ৬ থেকে ৯ মাস ট্রেনের ট্রায়াল রান চালানো প্রয়োজন। আমরা ২ থেকে ৩ মাস চালিয়েছি। এটা তখনকার সরকার চেয়েছে। আমার মনে হয় যারা এটা করেছে এবং যারা এটা দেখেছে দুই পক্ষই দায়ী। মেট্রোরেল ডিজাইন করার সময় বাংলাদেশের ফিচারগুলো বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এদেশে বৃষ্টি হবে, রোদ হবে, ধুলো পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এটা করার মতো আমাদের সক্ষমতা ছিল না তখন হয়তো।
ওদিকে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে মেট্রোরেলের ফার্মগেট স্টেশনের কাছে একটি পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ার ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় দশ ঘণ্টারও বেশি সময় বন্ধ থাকে মেট্রোরেল চলাচল। এক বছর পর গত রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেটে পুনরায় বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে পথচারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর ২২ ঘণ্টা মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ থাকে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে মানবজমিনের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে মো. আব্দুল বাকী মিয়া বলেন, প্রতিবেদনের বিষয়ে আমার কিছু মনে নেই। পরে ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট মানবজমিনের হাতে আসে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, দৈনন্দিন ট্রেন চলাচলের কারণে গার্ডারের বিচ্যুতি এবং সংকোচনের ঘটনা ঘটতে পারে। এ জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল পথের সব বিয়ারিং পরীক্ষা করা এবং ড্রোনের মাধ্যমে ছবি তুলে তা সংরক্ষণের পরামর্শ দেয়া হয়। পাশাপাশি বিয়ারিংগুলো আটকে রাখার জন্য ইস্পাতের কাঠামো যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়।
অন্যদিকে, ২২ ঘণ্টা পর ট্রেন চালু করে বুধবার সন্ধ্যায় ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে যাত্রীদের নিরাপদ ও দুশ্চিন্তামুক্ত যাত্রার নির্দেশনা দেয় মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান। ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ফের বন্ধ করে দেয়া হয় আগারগাঁও থেকে শাহবাগ অংশ। তবে এই বিষয়ে ডিএমটিসিএলের পক্ষ থেকে সরাসরি যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়ে জানানো হয়নি। বৃহস্পতিবার সরজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, বুধবার রাতে মেট্রোরেল সংসদ ভবন এলাকায় নিখুঁতভাবে চলছিল না। কেঁপে কেঁপে চলছিল। ফলে ট্রেনটি আগারগাঁও স্টেশনে থামিয়ে যাত্রীদের নেমে যেতে বলা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। লাইন চেক করার পরও ফের এমন ত্রুটি দেখা দেয়ার সম্ভাব্য কারণ কী, এমন প্রশ্নের জবাবে বুয়েটের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাদিউজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, মেট্রোরেলের ওই অংশের নকশায় ভুল রয়েছে। তাই বারবার সেই অংশেই বেশি সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশের নকশাজনিত ভুল আছে কিনা সেই প্রশ্নের জবাবে মেট্রোরেলের এমআরটি লাইন-৬ এর বর্তমান প্রকল্প পরিচলাক ব্রিগে. জেনা. (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব মানবজমিনকে বলেন, এমন ত্রুটি রয়েছে কিনা এই বিষয়ে নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। যেহেতু কয়েকদিন আগে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটিও হয়েছে, আশা করি কমিটির প্রতিবেদনে সব উঠে আসবে।
মেট্রোরেলের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। মেট্রোরেলের নিরাপত্তার জন্য বাজেট রাখা হয়নি বলেও কড়া সমালোচনা করছে নাগরিকরা। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান। ডিটিসিএ থেকে অভিযোগে জানানো হয়েছে, মেট্রোরেলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন, সেফটি সার্টিফিকেট, মেট্রোরেল ও যাত্রীদের বীমা, নির্মাণ পরিকল্পনা, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত প্রতিবেদন ইত্যাদি কারিগরি বিষয়াদি দীর্ঘদিন যাবৎ পেন্ডিং রয়েছে, যেগুলো মেট্রোরেল চালু হওয়ার পূর্বেই সম্পন্ন করা অত্যাবশ্যক ছিল। এ সমস্ত কার্যক্রম সম্পাদিত না হওয়ায় মেট্রোরেল ব্যবহার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মু. ফাওজুল কবির খান মানবজমিনকে বলেন, মেট্রোরেলে সম্প্রতি দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তারা তাদের কাজ করছেন।