চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে গঠিত হয়েছিল ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। প্রধান উপদেষ্টাকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিশনের মেয়াদ রাখা হয় ছয় মাস। পরে কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে ২৮ অক্টোবর ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ পেশ করে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। ওই সুপারিশ পেশ করার পর দেখা যায় বিএনপির পক্ষ থেকে কমিশন সভায় যেসব বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (দালিলিকভাবে ভিন্নমত পোষণ) দেওয়া হয়েছে সেসব পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে। জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর নেওয়ার সময় সনদে উল্লেখ ছিলনা এমন অনেক কিছুই সুপারিশমালায় সংযুক্ত করা হয়েছে। এমনকি কমিশন বৈঠকে কখনো আলোচনাই হয়নি এ রকমের বেশকিছু বিষয়ও সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়নি সেগুলোকেও একমত হিসেবে দেখানো হয়েছে কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেওয়া সুপারিশে। মঙ্গলবার এই সুপারিশমালা জমা দেওয়ার পর কমিশনে বিএনপির প্রতিনিধিত্বকারী দলের নেতৃত্বে থাকা দলটির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন ঐকমত্য কমিশন অনৈক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে আজ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন সুপারিশমালায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বাদ দিয়ে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে ঐকমত্য কমিশন। বিএনপি মহাসচিবের ভাষ্য, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ঐক্য হতে পারে না। তাহলে এই কমিশন কেন করা হয়েছিল? জনগণের সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এটা প্রতারণা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে থাকা সদস্যরা কোন মতাদর্শের লোক? রাজনৈতিকভাবে তারা কোন দলকে পছন্দ করেন, তারা কী একেবারেই নিরপেক্ষ নাকি ভেতরে ভেতরে কোনো একটি দলের পক্ষাবলম্বন করছেন, এমন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে মঙ্গলবার কমিশন সুপারিশ পেশ করার পর থেকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কখনোই বিএনপির সমর্থক ছিলেন না। বিএনপির রাজনীতি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে অতীতেও তিনি কোনো সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন এমন কোনো নজির নেই। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যের মধ্যে এমন একজনও পাওয়া যাবে না যিনি দূর থেকেও বিএনপিকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে কমিশনের সদস্যের মধ্যে অন্তত একজন আমলা রয়েছে যিনি জামায়াতে ইসলামীর সদস্য (রুকন) বলে জানা গেছে। এদিকে ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল এমন ব্যক্তি রয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে। ফলে এই কমিশনের বৈঠক, আলোচনা-পর্যালোচনা এবং পদক্ষেপ বিএনপির ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য ইতিবাচক হওয়ার আশা করার কোনো কারণ নেই। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশন গঠনের পর যাদের সদস্য করা হয়েছে, তাদের বিষয়ে আগ থেকে সুস্পষ্ট ধারণা নিয়ে সেই মোতাবেক তৎপরতা চালানো দরকার ছিল বিএনপির, কিন্তু দলটি সেটি করেনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্য কমিশন যে এতটা প্রতারণা করবে, এটা আদতে বিএনপির ধারনায়ই ছিল না। শুধু বিএনপিই নয়, সাধারণ সচেতন মানুষের আস্থাকেও এক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করা হয়েছে, বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
কমিশন সভাপতির কাছে জমা দেওয়া সুপারিশমালায় ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বাদ দেওয়া এবং কমিশনে আলোচনা হয়নি এমন অনেক কিছু সংযোজন করার পর বিএনপির মহাসচিব বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছে ঐকমত্য কমিশন। মির্জা ফখরুল বলেন, যে বিষয়গুলোতে তাঁরা (বিএনপি) একমত ছিলেন না, সেখানে তাঁরা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। সেই নোট অব ডিসেন্ট সুপারিশে লিপিবদ্ধ করার একটা প্রতিশ্রুতি ছিল কমিশনের। কিন্তু অবাক হয়ে তাঁরা (বিএনপি) লক্ষ্য করলেন, সুপারিশে সেই বিষয়গুলো নেই। নোট অব ডিসেন্টগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। ইগনোর করা হয়েছে। এটা তো ঐক্য হতে পারে না। তাহলে ঐকমত্য কমিশনটা করা হয়েছিল কেন? সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনি কিন্তু এইবার জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ওয়াদাবদ্ধ। এখানে সত্যিকার অর্থেই যেটুকু সংস্কার দরকার, সেই সংস্কারগুলো করে আপনি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন দেবেন। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে পার্লামেন্ট আসবে, সেই পার্লামেন্ট এই দেশের সংকটগুলো সমাধান করবে। সুতরাং আজকে যদি এর থেকে কোনো ব্যত্যয় ঘটে, এর থেকে বাইরে যদি যান, তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনাকেই বহন করতে হবে। এ কথাটা আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই।’
মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার পর বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে, সেই স্বাক্ষরিত সনদবহির্ভূত অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ, সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ৮৪টি দফা সম্ভবত, সেখানে বিভিন্ন দফায় আমাদের এবং বিভিন্ন দলের কিছু ভিন্নমত আছে, নোট অব ডিসেন্ট আছে। পরিষ্কারভাবে সেখানে উল্লেখ করা আছে যে এই সমস্ত নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলসমূহ যারা দিয়েছে, তারা যদি নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তাঁরা সেভাবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। সেটা এই প্রিন্টেড জাতীয় জুলাই সনদের যে বই এখানে আপনারা পাবেন সমস্ত দফায় দফায় যেখানে যেখানে ডিসেন্ট আছে সেখানে আছে। অথচ বিস্ময়করভাবে আজকে (২৮ অক্টোবর) যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হলো সুপারিশমালার সাথে, সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নাই।’
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘হয়তোবা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমস্যাটা নিয়ে আবার আলোচনা হতে পারে। এখানে একটা নতুন বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদের নামে একটা আইডিয়া এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে। যেটা আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কখনো টেবিলে ছিল না, আলোচিত হয়নি। এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি।’ সালাউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমরা জানি, আসন্ন যে নির্বাচনটা হবে সেই নির্বাচনটা হবে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন। এখন সেই সংসদ সদস্যদের যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়, সেটা তো জাতীয় সংসদেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন জাতীয় সংসদে কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তো আলোচিত হয়নি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে। এ বিষয়ের কোনো সুপারিশ বা এ বিষয়ে কোনো আলোচনা না হওয়ার পরও এই সুপারিশমালার মধ্যে হঠাৎ করে যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ একই সাথে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, উনারা এই সিদ্ধান্তটা আরোপ করতে পারেন না। চাপিয়ে দিতে পারেন না।’
গণভোটে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে রায় এলে যে প্রক্রিয়ায় এই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই নোট অব ডিসেন্টসহ সেটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য থাকবে বলে উল্লেখ করেন সালাহউদ্দিন আহমদ। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ভিন্নতা দেখছেন উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যে সমস্ত প্রশ্নগুলো আমি দেখলাম এখানে বলা হয়েছে আপার হাউসে অর্থাৎ উচ্চকক্ষে নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসনের মধ্য দিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এই রকম তো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ১০০ সদস্যের এবং তারা কীভাবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবে সেটার ব্যাপারে তো ঐকমত্য হয়নি।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচন নিম্নকক্ষে সদস্যের অনুপাতে অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনে কোন দলগুলো কতগুলো আসন পেল, তার ভিত্তিতে বণ্টনের কথা বলা হয়। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গ তুলে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কেউ ভোটের অনুপাতে চেয়েছে, আমরা চেয়েছি নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে। এখানে বলা আছে যেভাবে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া হয়েছে সেই নোট অব ডিসেন্টগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি আমরা ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হই বা কোনো দল হয়, ওই সময় ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হয়ে তারা সেইভাবে সেটা বাস্তবায়ন করবে। তারপরে এখানে পিআরের ভিত্তিতে তারা প্রস্তাব সরাসরি করে ফেললেন এবং এখানে কোনো নোট অব ডিসেন্টের উল্লেখ নাই।’ তিনি বলেন, জনগণের সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার কারও নেই। এই বিষয়গুলো আলোচিত হওয়ার পরেও নোট অব ডিসেন্ট থাকার পরেও তাঁরা সরাসরি এই আদেশের সংযুক্তিতে রেখেছেন। এগুলো কোনোভাবে বিবেচনা করা যায় না।’
আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো অনুমোদন না করলে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তার কঠোর সমালোচনা করেছেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এসব পদক্ষেপকে ও অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা বলে মন্তব্য করেন বিএনপির অন্যতম এই নীতিনির্ধারক।
শীর্ষনিউজ