Image description

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে এটি কীভাবে কার্যকর হবে এ নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কমিশন তাদের সুপারিশে নতুন একটি ধারায় “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” হিসেবে কাজ করবে। তারা ২৭০ দিনে জুলাই সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো কার্যকর করতে না পারলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হবে। জুলাই সনদ সইয়ের আগে এই ধারাটি যুক্ত ছিল না।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও সমমনা দলগুলোর পক্ষ থেকে “গণভোট” জাতীয় নির্বাচনের দিনে করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও এটি তার আগেই করা যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছে কমিশন। এছাড়া “নোট অব ডিসেন্ট” বাদ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগেই বলে আসছে, তারা নির্বাচনের দিন গণভোট চায় না। তাদের দাবি, নভেম্বরেই গণভোট এবং সেই প্রক্রিয়ায় সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে।

দলটির দুটির নেতাদের ধারণা, একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে গণভোটের প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে।

এনসিপিসহ চার বাম দল এখনও সনদে সই করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন দ্বিমতের বাস্তবতায় জুলাই সনদ আদৌ কার্যকর হবে কি-না সে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে তাদের কনস্টিটিউশন পাওয়ার বা গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা আমরা কেউ কেউ বলেছিলাম। তবে তারা ২৭০ দিনে কার্যকর করতে না পারলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হয়ে যাবে, এমন প্রস্তাব পৃথিবীর কোনও দেশে আছে কিনা জানা নেই। আমি মনে করি, এটি পরবর্তী সংসদের ওপরই ছেড়ে দিলে ভালো হতো। আর সময়সীমা ৯ মাসের পরিবর্তে ৬ মাস হওয়ার দরকার ছিল।”

তিনি আরও বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের প্রস্তাব বেশিরভাগ দলেরই ছিল। সেখানে কমিশন তার আগেও গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে, এটা ঠিক করেনি।” তবে নোট অব ডিসেন্ট না রাখাকে তিনি ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।

এ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ।

মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ হস্তান্তরের পর বিকালে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “এ সুপারিশে কমিশন ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে। অঙ্গীকারনামায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। নোট অব ডিসেন্টও বাদ দেওয়া হয়েছে।” তিনি কমিশনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিহিত করেন।

সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশে কী আছে?

জুলাই সনদে কী কী থাকবে সে বিষয়ে একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে এটি কার্যকরে তিনটি প্রক্রিয়ার ওপর দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটে অনুমোদন পাওয়া সংবিধান সংস্কার বিল পরিষদের সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে এবং পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।

দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকার জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫–এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলো কার্যকরের জন্য “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫” জারি করবে।

আদেশ এবং এর তফশিলে উল্লিখিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। আদেশ জারির পর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, যা সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে গাঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। যেখানে একটি প্রস্তাবে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একইসঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে।

অন্য প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে এবং সংস্কার কার্যক্রম শেষ হলে পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হবে।

গত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫–এ সই করা হয়/প্রেস উইংগত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫–এ সই করা হয়/প্রেস উইং

এ ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে রাজনীতিবিদদের অতীতে কোনও ধারণা ছিল না। তারপরও আমরা এর কার্যক্রমে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেছি। কমিশন সুপারিশ করেছে ভালো কথা। কিন্তু অধ্যাদেশের যে কথা বলা হয়েছে, তা তো সংবিধানে নেই। তাই বিষয়টি পরবর্তী সংসদের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে।”

অনিশ্চয়তা দেখছে না জামায়াত ও এনসিপি

কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে জুলাই সনদ কার্যকর প্রক্রিয়া ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, “তিন ধাপে সনদ বাস্তবায়নে কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে, তা ভালো দিক।”

সংবিধান সংস্কার পরিষদকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে তার সমর্থন রয়েছে। তবে গণভোট নভেম্বরই করার পক্ষে তার দল। তার মতে, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের আয়োজন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তার ভাষ্য, এতে নির্বাচনি প্রচারণার ঢেউয়ে গণভোট গুরুত্ব হারাতে পারে। অবশ্য যেকোনও প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। এক্ষেত্রে কোনও অনিশ্চয়তা দেখছেন না এই জামায়াত নেতা।

এনসিপি'র সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে প্রাথিকভাবে ইতিবাচকভাবেই দেখছি। বিশেষ করে নোট অব ডিসেন্ট তুলে নেওয়া, গণ-অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেটে বাস্তবায়ন আদেশ জারি, পুরো সনদ হ্যাঁ-না প্রশ্ন আকারে গণভোটে যাওয়া। এগুলোকে সবারই মেনে নেওয়া উচিত। তবে গণভোট নির্বাচনের আগে হওয়াই যুক্তিযুক্ত।” এতে সনদ বাস্তবায়ন আরও সহজ হবে বলে তিনি মনে করেন।

নয় মাসের কার্যক্রম “পণ্ডশ্রম”

সংবিধানের চার মূলনীতি প্রশ্নে গত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেনি চার বাম দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ)। ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশনের দেওয়া সুপারিশকেও তারা একপেশে হিসেবে দেখছেন। তাদের অভিযোগ, কমিশন কথা রাখেনি।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি)'র সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের ৯ মাসের কার্যক্রম পণ্ডশ্রমে পরিণত হয়েছে। তারা সব সময় নিজেদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক যে আদেশের কথা বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আদালতে গেলে টিকবে না। কারণ, একটি সংবিধান বিদ্যমান থাকতে এ ধরনের আদেশের বৈধতা নেই।”

তিনি আরও বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সমাধান না করতে পারলে, প্যানেল ভেঙে দেওয়ার বিধান থাকা উচিত ছিল। আর ঐকমত্য না হওয়া বিষয়গুলো না রাখার সিদ্ধান্তও সঠিক হয়নি।” তিনি মনে করেন, এসব কারণে এ মুহূর্তে সনদে সই করা না করা সমান।

বাসদের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা প্রথম থেকেই সনদে নোট অব ডিসেন্টগুলো রাখার প্রস্তাব দিয়ে আসছি। কমিশন এতদিন এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু না বললেও এখন সুকৌশলে বাদ দিয়ে দিয়েছে। আর সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে কার্যকর করতে না পারলে অটোমেটিক আইনে পরিণত হওয়ার প্রস্তাব এক ধরনের প্রহসন। এ অবস্থায় গণভোট নিষ্প্রয়োজন।”