রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে মৃত্যু হয় আবুল কালাম নামে এক পথচারীর। একই ঘটনায় দুই জন আহতও হয়েছেন। এরপর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিকাল ৩টায় উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়। এরপর সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু করা হয়।
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে মৃত্যুর ঘটনায় ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানকার অভিযোগে স্পষ্ট প্রতীয়মান, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) গাফিলতিতে প্রাণ হারিয়েছে আবুল কালাম।
ডিএমটিসিএল’র গাফিলতি খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, রাজধানীর উত্তরা-মতিঝিল মেট্রোরেল নির্মাণে ব্যবহৃত বিয়ারিং প্যাডের মান নিয়ে ২০২০ সালেই প্রশ্ন উঠেছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক পরীক্ষায় দেখা যায়, প্রকল্পের উত্তরা-আগারগাঁও অংশে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা বিয়ারিং প্যাডের একটি অংশ মানোত্তীর্ণ নয়। যা সরবরাহ করেছিল প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি।
এই মানহীন বিয়ারিং প্যাড মেট্রোরেলের উত্তরা-আগারগাঁও অংশের প্যাকেজ ৩ ও ৪-এর নির্মাণকাজে সরবরাহ করা হয়েছে। এ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার, যার মধ্যে আট কিলোমিটার উড়ালপথে মানহীন বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা হয়েছে। অবশিষ্ট অংশে মানহীন এসব বিয়ারিং প্যাড ব্যবহারের কথা ছিল। কিন্তু বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে পরীক্ষা শেষে একাধিক প্যাডকে মানহীন ঘোষণা করার ফলে নতুন বিয়ারিং প্যাড আমদানি করতে হয়েছে।
স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে আবুল কালাম (ছবি: সংগৃহীত)
বিয়ারিং প্যাডে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ঠিক করেনি ডিএমটিসিএল
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেট্রোরেলের বিয়ারিং এই প্যাড আগে থেকেই খারাপ ছিল। যার কারণে বিজয় সরণি থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ধীরগতিতে চলতো মেট্রো। এটা জানা সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি ডিএমটিসিএল। গত বছর সেপ্টেম্বরে একই এলাকায় আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনা ঘটেছিল, যা নিয়ে তখনও নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, বিয়ারিং প্যাডগুলো ঠিক আছে কিনা এবং এগুলো ক্ষয় ও ডিসপ্লেস হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে একটি সার্ভে করা হয়েছিল। সেই সার্ভেতে বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে। কিন্তু ডিএমটিসিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গড়িমসিতে তার ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
ত্রুটিপূর্ণ বিয়ারিং প্যাড নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আজহারুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেট্রোরেলে মোট পিলার আছে ৬২০টি। প্রতিটি পিলারে চারটি করে বিয়ারিং প্যাড আছে। সে হিসেবে মেট্রোরেলে মোট বিয়ারিং প্যাড আছে ২ হাজার ৪৮০টি। গত বছর ৪৩০ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। আজ ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে। এমন আর কতটা ত্রুটিপূর্ণ বিয়ারিং প্যাড আছে তা আল্লাহ ভালো জানেন।’
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাডে ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও কেন ঠিক করা হয়নি এবং বিয়ারিং প্যাড নিয়ে হওয়া সার্ভে অনুযায়ী রিমেডিয়াল অ্যাকশন বাস্তবায়িত হয়নি কেন এর জবাব জানতে মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি জবাব দেননি। এমনকি তার পিএস জাহিদুল ইসলামকে প্রশ্ন লিখে পাঠালেও তিনি কোনও উত্তর দেননি।
এবার কি টনক নড়বে ডিএমটিসিএলের
এক বছরের ব্যবধানে মেট্রোরেলে এ নিয়ে দুইবার বিয়ারিং প্যাড খুলে দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি, তবে ১১ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রতিবেদনে সঠিক কারণ আলোর মুখ দেখেনি।
প্রথমবার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় যদি তদন্ত সহকারে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে আজ আবুল কালামের প্রাণহানি হতো না বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। আবুল কালামের মৃত্যুর জন্য ডিএমটিসিএলকে দায়ী করে এক প্রবাসী ফেসবুকে লেখেন, ‘এটা কেবল ডিএমটিসিএলের গাফিলতির মৃত্যু। প্রথম যেদিন বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে সেদিন যদি সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে আজ কালামের মৃত্যু হতো না। বাংলাদেশে কেন জানি না মৃত্যুর পরই কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। জানি না এবার ডিএমটিসিএলের টনক নড়বে কিনা।’
কেন বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়লো, মৃত্যু মধ্যে দিয়ে এবার কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে কিনা এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ আজ দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘কেন বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ল, তা তদন্ত করা হবে। কার দায়-দায়িত্বে অবহেলা আছে, তাও বের করা হবে। নকশায় ত্রুটি থাকার বিষয়টিও নাকচ করছি না। সবকিছুই তদন্ত করে বের করা হবে।’
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এ ঘটনার তদন্তে সেতু সচিবের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনাটি কী নাশকতা, না নির্মাণত্রুটির কারণে হয়েছে, সেটা খুঁজে বের করা হবে।
আবুল কালামের ছবি হাতে নিয়ে কাঁদছেন বড় বোন সেলিনা বেগম
মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও পরিবারের সঙ্গে কথা হয় কালামের
মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড মাথায় পড়ে নিহত আবুল কালামের আকস্মিক মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ পরিবারের সদস্যরা। নিহত কালামের চাচাতো ভাই আব্দুল গণি চোকদার জানান, দুপুরে মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেই কথা বলেছিলেন পরিবারের সঙ্গে। তারপর আমরা টিভিতে খবর দেখি মেট্রোরেলের নিচে একজন মারা গেছে। পরে যখন ফেসবুকে একটা পাসপোর্টের ছবি দেখি তখনই বুঝতে পারি আমাদের কালাম মারা গেছে।
জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করতেন কালাম। পরিবার নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। ব্যবসায়িক কাজে নিয়মিত ফার্মগেট এলাকায় যাতায়াত করতেন। প্রতিদিনের মতো রবিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে ব্যবসায়িক কাজে আসেন কালাম। এরপর কাজের জন্য সেখান থেকে বের হয়ে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ফার্মগেট এলাকায় যান। সেখানেই মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে তার মাথায় পড়লে ঘটনাস্থলেই মারা যান। নিহত কালামের দুই সন্তান। ছেলেটির বয়স পাঁচ বছর আর মেয়েটির বয়স মাত্র তিন বছর।