Image description

কর্মক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ড বা যেকোনও দুর্ঘটনা, সড়কে বাস দুর্ঘটনা, কিংবা নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিক নিহতের ঘটনায় যে অবহেলা, তার দায় কেউ নেয় না। এমনকি দেশে কী পরিমাণ ‘অবহেলাজনিত’ মৃত্যুর শিকার হয় মানুষ—তা নিয়ে কোনও গ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যানও নেই। বিষয়গুলো যে ‘অবহেলাজনিত’ মৃত্যু, সেটাই কেউ স্বীকার করে না।

যদিও ‘বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০’-এর ৩০৪(ক) ধারায় বলা আছে, “যে ব্যক্তি কোনও অবহেলা বা বেপরোয়া কাজ দ্বারা অন্য ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়, কিন্তু তা হত্যা নয়, সে ব্যক্তি সর্বাধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।” অর্থাৎ যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা না করে, কিন্তু তার অসতর্কতা বা দায়িত্বহীনতার কারণে কারও মৃত্যু ঘটে, তবে সেটি ‘অবহেলাজনিত’ মৃত্যু হিসেবে গণ্য হবে।

রবিবার (২৬ অক্টোবর) রাজধানীর ফার্মগেটে মেট্রোরেল স্টেশনের কাছে একটি ‘বিয়ারিং প্যাড’ খুলে পড়ে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। ট্রেন চলাচলের সময় কম্পন প্রতিরোধে ব্যবহৃত এই যন্ত্রাংশটি আলগা হয়ে নিচে পড়ে। সেটি আবুল কালাম নামে এক ব্যক্তির মাথায় পড়লে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঘটেছিল একই ধরনের আরেকটি ঘটনা। তখনও ফার্মগেট সংলগ্ন এলাকায় মেট্রোরেলের ওপর থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। ওই ঘটনা মেট্রোরেলের নকশা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে গুরুতর নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। সে সময় জানা যায়, মেট্রোরেল বা যাত্রীদের জন্য কোনও বিমা কাভারেজ নেই। প্রযুক্তিগত ত্রুটিজনিত দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের কোনও নীতি গৃহীত হয়নি। ঠিক এক বছর পর আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও কোনও দায় না থাকায় সমালোচনার মুখে পড়েছে কর্তৃপক্ষ।

নির্মাণাধীন ভবনে শ্রমিকের মৃত্যু

বেসরকারি সংস্থা সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির তথ্যমতে, ২০২৪ সালে দেশজুড়ে ৬৩৯টি দুর্ঘটনায় মোট ৭৫৮ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ১৫টি জাতীয় ও ১১টি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মৃত্যুর মিছিলে তৃতীয় স্থানে আছে ৯২ জন শ্রমিক নিহতের ঘটনা। এসব ঘটনায় দায়ীরা হলেন ঠিকাদার, প্রকল্প মালিক, বিল্ডিং মালিক, সাইট সুপারভাইজার। কোনও ঘটনাতেই মামলা হওয়ার নজির নেই। এমনকি সব ঘটনায় শ্রম আইন মেনে ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা হয় না। এসব মৃত্যু ‘অবহেলাজনিত’ বলেও বিবেচিত হয় না।

এই অস্বাভাবিক মৃত্যুগুলো অবহেলাজনিত হিসেবে চিহ্নিত হয় না কেন প্রশ্নে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতানউদ্দীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘অবহেলাজনিত দূরে থাক, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে কোনও দুর্ঘটনার বিচার হয় না। আর এই যে রাস্তায় ও নির্মাণাধীন ভবনে—যারা মারা যান, তারা সাধারণ মানুষ। ফলে এসব মৃত্যু গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। এ ধরনের মৃত্যুকে অবহেলাজনিত চিহ্নিত করে, সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়ী করে—মামলার ব্যবস্থা থাকতে হবে। দরকার কড়া শাস্তি আর মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ। তা না হলে দায়ী ব্যক্তিরা সচেতন হবেন না, এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’’

কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মোট ২০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ঘটনা পরবর্তী তদেন্ত দেখা গেছে, অনেক কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত ছিল। সম্প্রতি মিরপুরের গার্মেন্টস কারখানায় রাসায়নিক গোডাউনের বৈধতা ও ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেটের অভাব ছিল, যা অগ্নিকাণ্ডের পরিণতিকে আরও ভয়াবহ করেছে।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে মোট ২৬,৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৪০ জন নিহত ও ৩৪১ জন আহত হয়েছেন। কারখানার দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কারখানার মালিক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রশাসক, নিরাপত্তা পরিদর্শকের দায়ী হওয়ার কথা থাকলেও কোনও ঘটনায় তাদের দেখা পাওয়া যায় না।

যেকোনও ঘটনার পরে গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা, জরুরি বের হওয়ার দরজা বন্ধ থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগের বিষয়গুলো উঠে আসে, যেগুলো স্পষ্টতই ‘অবহেলাজনিত’।

বাসচাপায় মৃত্যু

২০২৪ সালে দেশে মোট ৭,২৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭,২৯৪ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৬৯ জন বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত দুর্ঘটনায় মারা যান, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৫.০৫ শতাংশ। এ ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবসময়ই বাসের ফিটনেস না থাকা, চালকের লাইসেন্স না থাকা, বা অভিজ্ঞতার অভাব, অতিরিক্ত যাত্রীবাহী বা ওভারলোডিং, দ্রুতগতি, ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ম অমান্য করার বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে আসে। যার জন্য সরাসরি চালক, গাড়ির মালিক, কখনও পরিবহন কোম্পানি, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ—যারা লাইসেন্স ও ফিটনেস দিয়ে থাকে, তারা দায়ী হলেও কেবল চালক ও হেলপারকেই দায়ী করা হয়।

শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন যারা তারা বলছেন, ‘অবহেলাজনিত’ মৃত্যুর দায় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনটি মূল উপাদান থাকতে হবে। কোনও কাজ বা অবহেলা ঘটেছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি কিছু করেছেন বা করা উচিত ছিল, এমন কিছু করেননি। কাজটি বেপরোয়া বা অবহেলাপূর্ণ ছিল— অর্থাৎ, একজন সাধারণ সচেতন ব্যক্তি একই পরিস্থিতিতে যেভাবে সতর্ক থাকতেন, অভিযুক্ত তেমন ছিলেন না। ফলাফল হিসেবে মৃত্যু ঘটেছে—ওই অবহেলা বা কাজের ফলেই অন্য ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।

দুর্ঘটনায় মারা গেলেও তা ‘অবহেলাজনিত’ মৃত্যু হিসেবে চিহ্নিত হয় না, বিচারেরও নজির নেই কেন, প্রশ্নে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার বলেন, ‘‘আমরা দীর্ঘদিন বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে ছিলাম। শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়নটা হয়নি। নাগরিক হিসেবে তাদের যেন কোনও মর্যাদা নেই। সে কখনও আগুনে, কখনও পানিতে ডুবে, গাড়িচাপা পড়ে মারা যাবে। তার কোনও প্রয়োজন নেই। তবে ইতোমধ্যে শ্রম আইনে পরিবর্তন হয়েছে, শ্রম সংস্কার কমিশন হয়েছে—সবখানেই একটা আলোচনা আছে, শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য যেটা দরকার, সেটা করতে হবে এবং ‘অবহেলাজনিত’ মৃত্যুর যথাযথ শাস্তি হতে হবে। মেট্রোরেলের যে ঘটনা সেটা কেন ঘটলো, কারা দায়ী—সেটা তদন্ত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমরা এ ধরনের ঘটনা আশা করি না। একইসঙ্গে কলকারখানা পরিদর্শনের দায়িত্বে যারা আছেন, তারা যেন মনিটরিংয়ের কাজটা ঠিকভাবে করেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে এই অনিয়ম ঘটতেই থাকবে।’’