Image description
চলতি বছর অপহরণ বেড়ে দ্বিগুণ

অপহরণের ঘটনা বেড়েই চলছে। শুধু ব্যবসায়ী নয়, রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। দুষ্কৃতকারীরা অপহরণ করে স্বজনদের কাছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করছে। এমনকি অপহরণের পর টাকা পেলেও খুন করতে দ্বিধা করছে না ওই চক্র। একের পর এক অপহরণ নিয়ে উদ্বেগ আর শঙ্কায় সাধারণ মানুষ। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্রমতে, গত বছরে সারা দেশে ৬৪২টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। এবং চলতি বছরের ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) অপহরণের ঘটনা ঘটে ৮১১টি। ২০২৩ সালে সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ছিল ৪৬৩টি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘটিত সকল অপরাধের পেছনে রাজনৈতিক বিরোধ, পূর্ব-শত্রুতা, সামাজিক-আর্থিক টানাপড়েনের সঙ্গে রয়েছে হতাশা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিস্বার্থ। 

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ঢাকার নবাবগঞ্জের বান্দুরা থেকে প্রতীক নামে ১৩ বছরের এক স্কুল শিক্ষার্থীকে মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ১৫ই জানুয়ারি ৫ অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, স্কুলে যাওয়ার পথে মাইক্রোবাসে করে প্রতীককে অপহরণ করা হয়। পরে দুপুরে দোহার উপজেলার ফুলতলা এলাকা থেকে প্রতীককে উদ্ধার করা হয়। এ সময় গাড়িচালকসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- পারভেজ, জুম্মন খান ও মিজান। স্কুলছাত্র প্রতীক সরকার উপজেলার বান্দুরা হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা এলাকার সঞ্জয় কুমার সরকারের সন্তান।

অভিনেত্রী রুবিনা আক্তার নিঝুমকে অপহরণের চেষ্টা করে উবারচালক রকি। পুলিশ জানায়, গত ২১শে জানুয়ারি দুপুরে নিঝুম বনশ্রী নিজের বাসা থেকে ধানমণ্ডি-৩২ এ যাওয়ার জন্য উবার অ্যাপসে কল করেন। কল করার পর উবারচালক রকি একটি গাড়ি নিয়ে তার বাসার সামনে আসলে তিনি গাড়িতে ওঠেন। পরবর্তীতে রকি ধানমণ্ডি-৩২ না গিয়ে গুলশানের দিকে যেতে থাকে। এতে নিঝুম গুলশানে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রকি ধমক দেয় এবং কোনো কথা না বলে চুপ থাকতে বলে। অপহরণের বিপদ বুঝতে পেরে এমন পরিস্থিতিতে নিঝুম চিৎকার করে আশপাশে থাকা মানুষের কাছে সাহায্য চান। এতে রকি গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দেয় এবং একইসঙ্গে নিঝুমকে ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। চলন্ত অবস্থায় নিঝুম গাড়ির একটি দরজা খুলে বের হয়। রকি দ্রুত গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় নিঝুম রামপুরা থানায় মামলা করেন। এ মামলায় রোববার রকিকে বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গত ১১ই জানুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুরে আমিনুর রহমান (৪০) নামের এক চিকিৎসক অপহরণের শিকার হন। ৯ ঘণ্টা পর মুক্তি পান তিনি। আমিনুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক। তার পরিবারের সদস্যরা জানান, অপহরণকারীরা কয়েক দফায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে। এ ছাড়া তাকে মারধর করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা, দুটি স্মার্টফোন ও একটি ল্যাপটপ নিয়েছে অপহরণকারীরা। শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় একটি ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করেন আমিনুর। ঘটনার দিন দুপুরে ঢাকা থেকে তিনি শ্রীপুরে যান। ফেরার পথে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তাকে মাওনা চৌরাস্তায় মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অপহরণ করা হয়। তার মুঠোফোন নম্বর থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। কথা বলা অবস্থায় তাকে মারধর করা হচ্ছিল। রাতে তিন দফায় অপহরণকারীদের এক লাখ টাকা পাঠানো হয়। এভাবে মারধর করে দফায় দফায় টাকা দাবি করে। পরে ঘটনাটি পুলিশকে জানায়। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঘটনাটি জানার পর তার মুঠোফোনের অবস্থান শনাক্ত করে। এবং তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযান চালানো হয়। 

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, গত ৯ মাসে সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৮১১টি। এই ৯ মাসে শুধু ঢাকা মহানগরেই ১৯২টি ঘটনা ঘটেছে। গত বছরে অপহরণের ঘটনা ছিল ৬৪২টি। ঢাকা মহানগরে ছিল ১৩২টি। এবং সারা দেশে প্রথম ৯ মাসে ছিল ৪০৫টি। ২০২৩ সালে সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৪৬৩টি এবং ঢাকা মহানগরে ছিল ৬১টি। ২০২২ সালে সারা দেশে অপহরণের ঘটনা ঘটে ৪৬০টি। এ ছাড়া চলতি বছরের ৯ মাসে দেশে খুনের ঘটনা ঘটে ১৬ হাজার ৯৬২টি ও ঢাকা মহানগরে ১ হাজার ৪৪০টি। ২০২৪ সালে দেশে খুনের ঘটনায় মামলা ছিল ৩ হাজার ৪৩২টি ও ঢাকা মহানগরে ছিল ৩৩৯টি। এ ছাড়া চলতি বছরের ৯ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ৯৬২টি ও ঢাকা মহানগরে ১ হাজার ৪৪০টি। গত বছরে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১৭ হাজার ৫৭১টি ও ঢাকা মহানগরে ১ হাজার ৪৬০টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, দেশের বাস্তবতায় কোনো একটি রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখনকার অপরাধের পরিস্থিতি একরকম থাকে। অরাজনৈতিক কোনো সরকার থাকে তখনকার অপরাধ পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যেও একটা ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমান সময়ে অপরাধ প্রবণতা, অপহরণ, সহিংসতা, সংঘাত, খুনসহ নানাবিধ অপরাধ অনেক কমে আসার কথা কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। একটি রাজনৈতিক দলের সরকারের পতনের পর নতুন যে অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসেছেন তাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় স্বাভাবিক হয়েছে তবে পরিপূর্ণভাবে স্বাভাবিক হয়নি। দেশে একটি চক্রই তৈরি হয়েছে যারা অপরাধটি তার আয়-উপার্জনের উৎস মনে করে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং আমাদের কাছে যে অভিযোগগুলো এসেছে আমরা প্রত্যেকটি ঘটনাই গভীরভাবে তদন্ত করছি। অপহরণের ঘটনায় ভুক্তভোগী উদ্ধারসহ সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে অবহিত করতে হবে। অপরাধীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে পুলিশ সর্বদা তৎপর রয়েছে।