Image description
সীমানা নির্ধারণ, নতুন দল ও পর্যবেক্ষক নিবন্ধন

সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন দেওয়া এবং এনসিপিকে ‘শাপলা’ প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ‘কঠিন পরিস্থিতি’তে আছে ইসি। ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগ’ ও ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাজাহান সিরাজ)’ নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক তালিকায় রেখেছে। ইসির তদন্ত কর্মকর্তারা প্রতিবেদন দিয়েছেন দল দুটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ‘অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা’ নেই। নিষ্ক্রিয় দল দুটিকে নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রাখায় প্রশ্ন উঠেছে। দুটিসহ নিবন্ধনের সম্ভাব্য তালিকাভুক্ত ১৪টি রাজনৈতিক দলের তথ্য-উপাত্ত ‘অধিকতর’ তদন্ত করাচ্ছে কমিশন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আরও জানা গেছে, এবার জনসংখ্যার পাশাপাশি ভোটার সংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তবুও এক আসনের সঙ্গে আরেকটির জনসংখ্যায় সর্বোচ্চ ১৫৩ শতাংশ ও ভোটার সংখ্যার ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত বিশাল ব্যবধান রয়েছে। নতুন সীমানায় ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং ইসির নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে বড় ধরনের আইনি লড়াইয়ে পড়েছে ইসি, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হয়নি। অন্তত ২০টি আসনের সীমানা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে কমপক্ষে ২৭টি রিট আবেদন হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে ওইসব রিট নিষ্পত্তি করার দায় রয়েছে ইসির। এছাড়া পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন ও বিতর্ক উঠেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষক সংস্থার চূড়ান্ত নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবছে কমিশন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন কমিশন সবকিছু যাচাই-বাছাই করে প্রভাবমুক্তভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে। আমরা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি, যা নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। নতুন দল নিবন্ধনের বিষয়ে তিনি বলেন, কর্মপরিকল্পনা সামনে রেখে সম্ভাব্য রাজনৈতিক দলগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়েছে। তখন কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, তাদের মাঠ কার্যালয় সঠিকভাবে তদন্ত করা হয়নি। বিভিন্ন ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে অধিকতর তদন্ত হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা জানান, সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে আইনি লড়াই এবং নতুন দল নিবন্ধনের কাজ করতেই সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তাদের ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে। এতে অন্যান্য কাজে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটছে। তারা বলেন, ‘শাপলা’ প্রতীক ইস্যুতে ইসি ও এনসিপি বিপরীতমুখী অবস্থানে অনড়। এই ধরনের পরিস্থিতি সবার জন্য বিব্রতকর। ‘শাপলা’ রাষ্ট্রীয় প্রতীকের মূল অংশ এবং সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের লোগোতে শাপলা রয়েছে। এছাড়া কোনো দলের জন্য নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন করে প্রতীক দেওয়ার নজির নেই। বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করা গেলে ভালো। তারা জানান, জাতীয় নির্বাচনের অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কাজ যেমন ভোটগ্রহণ দ্রব্যাদি সংগ্রহ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল নির্ধারণের মতো কাজও চলছে।

রাজনৈতিক দল নিবন্ধন : কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শেষদিন গত ৩০ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে ১৫টি রাজনৈতিক দলের নাম প্রকাশ করে ইসি। সে সময়ে ইসি জানায়, ১৫টি দলের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া হিসাবে প্রতীক উল্লেখ করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, জাতীয় জনতা পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাজাহান সিরাজ)-এই তিনটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, জনতার দল, মৌলিক বাংলা এবং জনতা পার্টি বাংলাদেশ-এই নয়টি দলের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করা হবে। আর বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টিকে উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নিবন্ধন দেওয়া হবে। বাকি দলগুলোর আবেদন না-মঞ্জুর করা হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, নিবন্ধনের প্রাথমিক তালিকায় থাকা দলগুলোর বিষয়ে কারও আপত্তি থাকলে তা জানাতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার কথা। গতকাল পর্যন্ত ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে পারেনি ইসি। এর আগেই তালিকায় থাকা দলের বিষয়ে আপত্তি আসতে শুরু হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক তালিকায় থাকা দলগুলোর বিষয়ে অধিকতর তদন্তে ইসির পদক্ষেপে আপত্তি জানিয়ে ইসিতে চিঠি দিয়েছে আমজনতার দলসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তারা দ্রুত নিবন্ধন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিবন্ধনের শর্ত হিসাবে একটি কেন্দ্রীয়, ২১টি জেলা ও ১০০ উপজেলায় কার্যালয় ও কমিটি থাকার নিয়ম রয়েছে। এনসিপি ওই শর্ত পূরণ করেছে। বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টির ২০ জেলা ও ৯৯ উপজেলায় কার্যালয় পাওয়া গেছে। আর স্বাধীনতার পর কোনো এক নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বা নির্দিষ্ট হারে ভোট পাওয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) নিবন্ধনের প্রাথমিক তালিকায় রাখা হয়েছে।

যদিও ইসির কর্মকর্তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) কেন্দ্রীয় দপ্তরের অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) একটি টিনের ঘরকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়েছে। সেখানে জনসাধারণের যাতায়াতের সুযোগ কম। বাংলাদেশ জাতীয় লীগের চেয়ারম্যান পটুয়াখালীতে অবস্থান করেন। একটি ভবনের অন্য কাজে ব্যবহৃত বেইজমেন্টের এক রুমকে দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর হিসাবে দেখানো হয়েছে। যে দুটি দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও কার্যালয়ের কার্যকারিতা নেই, সেই দুটি দলকে তালিকায় রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে জাতীয় জনতা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও কার্যালয়ের কার্যকারিতা পেয়েছেন ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বাকি যে নয়টি দলের বিষয়ে অধিকতর তদন্ত হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটিই শর্ত পূরণ করতে পারেনি।

সীমানা নিয়ে রিটের হিড়িক : জানা গেছে, ১৬টি জেলার ৪৬টি আসনে রদবদল করে জাতীয় সংসদের চূড়ান্ত সীমানা প্রকাশ করে ইসি। জনসংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার ভারসাম্য রক্ষার যুক্তি দেখিয়ে ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ কয়েকটি আসনের অখণ্ডতা ভেঙেছে কমিশন। এসব জেলায় একই উপজেলাকে একাধিক আসনে বিভক্ত করা হয়। যদিও চূড়ান্ত সীমানায় ভোটার ও জনসংখ্যার বড় ব্যবধান রয়ে গেছে। এর অন্যতম হচ্ছে ঢাকা-১৯ আসন। এই আসনে ঢাকার গড় জনসংখ্যার চেয়ে ১৫৩ শতাংশ মানুষ এবং গড় ভোটারের চেয়ে ৭৭ শতাংশ বেশি ভোটার রয়েছেন। গাজীপুরে একটি আসন বাড়ানোর পরও গাজীপুর-৪ আসনে ওই জেলার গড় জনসংখ্যার চেয়ে ৫৭ শতাংশ জনগণ এবং ২৮ শতাংশ কম ভোটার রয়েছে।

পুনর্নির্ধারিত ওই সীমানা নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় সহিংস ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও জড়িয়ে পড়েন। বাগেরহাট জেলায় একটি আসন কমানোর প্রতিবাদে সেখানকার বাসিন্দারা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। একইভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় নানা কর্মসূচি পালন করেন সংক্ষুব্ধরা। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের হস্তক্ষেপে ওইসব আন্দোলন বন্ধ হওয়ায় কিছুটা স্বস্তিতে ইসি। তবে চলছে আইনি লড়াই, যাতে ইসি কিছুটা হলেও বিব্রত।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে অন্তত ২৭টি রিট হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি আসনের সীমানাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসনে একটি, ফরিদপুর-২ ও ৪ আসনে চারটি, কুমিল্লা-১ ও ২ আসনে চারটি, বাগেরহাট-১ আসনে দুটি, বাগেরহাট-৪ আসনে একটি, পাবনা-১ ও ২ আসনে চারটি, বরগুনা-১ ও ২ আসনে দুটি, ঢাকা-৪ ও ৫ আসনে একটি করে দুটি, কুমিল্লা-৬ আসনে একটি, সাতক্ষীরা-২ ও ৩ আসনে তিনটি, ঢাকা-১৪ ও ১৯ আসনে একটি, চট্টগ্রাম-৫ আসনে একটি এবং শরীয়তপুর-২ ও ৩ আসনে একটি করে রিট দায়ের হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনে সীমানা পুনর্নির্ধারণের এখতিয়ার ইসির। সীমানা নিয়ে উচ্চ আদালতে এত সংখ্যক রিট হতে পারে তা ইসির ধারণায় ছিল না। এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রিটের সংখ্যা বেড়েছে।

সীমানা পুনর্নির্ধারণ নিয়ে রিটের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার যুগান্তরকে বলেন, সহিংস আন্দোলনের চেয়ে আইনি লড়াই ভালো। আমরা সবগুলো রিটের বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছি। আশা করছি, রিটের কারণে নির্বাচনে কোনো সমস্যা হবে না।