
ঢাকার হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লেগেছে। আগুন নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসে ৩৭টি ইউনিট। যোগ দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন ও বিমান বাহিনীর ফায়ার ইউনিউও। গতকাল শনিবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (রাত ৯টা) আগুন নেভাতে সম্মিলিতভাবে কাজ করা হচ্ছে।
এদিকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে গতকাল রাতে চীফ (ফ্লাইট সেফটি) এর নেতৃত্বে সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। আগামী পাঁচ কর্ম দিবসের মধ্যে কমিটিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে আগুন লাগাকে অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশের ষড়যন্ত্র হিসেবে এবং বেবিচক ও কাস্টমসের দুর্বলতাকে দেখছেন। কারণ কার্গো ভিলেজ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি স্থান। অগ্নিকা-ের ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে, এটি কতটা অনিরাপদ। যদিও ঢাকা কাস্টম হাউজ সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা কাস্টমস কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এনবিআর ও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) একাধিকবার চিঠি দিয়ে অগ্নিকা-ের ঝুঁঁকির কথা জানানো হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরেও অস্ত্র, গোলাবারুদ সরিয়ে নিতে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অপরদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বেবিচক কর্মকর্তা বলেন, আমরা কাস্টমসের এ ধরণের চিঠি পাইনি। পাশাপাশি বেবিচক কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বদা সচেষ্ট ছিল। তবে দুর্ঘটনার দায় কারো এড়ানোর কোন সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে গতকালের আগুনের কারণে সাময়িকভাবে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ঢাকাগামী ফ্লাইটগুলো চট্টগ্রাম ও সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে ঢাকাগামী কয়েকটি ফ্লাইট বিকল্প রুটে পাঠানোর কথাও জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা কয়েকটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও বিমানবন্দরে আটকে রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে সাধারণত তুলনামূলকভাবে কম ওজনের যন্ত্রপাতি, পচনশীল পণ্য, ইলেকট্রনিকস পণ্য আমদানি হয়ে থাকে। আগুনের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এখনো জানা যায়নি। তবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কা করেছেন আমদানিকারকেরা। আকাশপথে পণ্য পরিবহনকারী আরএমকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান ইবনে আমিন সোহাইল বলেন, এ ঘটনায় আমদানিকারকদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর বোঝা যাবে, ক্ষয়ক্ষতি কত হয়েছে কিংবা কবে নাগাদ আবার কার্গো ভিলেজ চালু করা যাবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিমানবন্দরে অগ্নিকা-ের ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। অগ্নিকা-ের উৎস শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এদিকে ঢাকা কাস্টমস হাউজও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলেও জানা গেছে।
নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কার্গো ভিলেজের মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি জায়গায় অগ্নিকা-ের ঘটনা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে যে, এটি কতটা অনিরাপদ। গত কয়েক বছর ধরেই আমরা রফতানিকারকরা অভিযোগ করে আসছি, আমাদের পণ্য খোলা জায়গায় রাখা হয়, যা নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঘটনাটি কেবল একটি দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে-তা খতিয়ে দেখতে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত তদন্ত শুরু করা উচিত। কারণ, গত কয়েকদিনে স্থানীয় ও রফতানিমুখী একাধিক পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ইপিজেডে সাম্প্রতিক অগ্নিকা-ের পর কার্গো ভিলেজে এ ধরনের ঘটনা আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে নিরাপত্তা বিষয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতি বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি করতে পারে।
সূত্র মতে, কার্গো ভিলেজ ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশ হলো তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা, যারা তুলনামূলকভাবে হালকা যন্ত্রপাতি ও ইলেকট্রনিক পণ্যের আমদানি এবং তৈরি পোশাক ও নমুনা পাঠানোর কাজে এটি ব্যবহার করে থাকেন।
আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসগুলোও এই কার্গো ভিলেজের মাধ্যমে তাদের গ্রাহকদের দলিলপত্র ও পার্সেল আকাশপথে আদান-প্রদান করে। এছাড়া, ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা কাঁচামাল আমদানির জন্য এবং কৃষিপণ্য রফতানিকারকরা-বিশেষ করে শাকসবজি ও অন্যান্য পচনশীল পণ্য রফতানির জন্য-এই কার্গো ভিলেজ ব্যবহার করেন।
ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম মিঠু বলেন, আগুন লাগার এক ঘণ্টা পর সিভিল এভিয়েশন ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। এতোক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পরে। সাধারণ মানুষজন আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিতে চাইলেও ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা নিরাপত্তার কারণে কাউকে অংশ নিতে দেয়নি। কারণ কার্গো ভিলেজে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রাসায়নিক দ্রব্য ও গার্মেন্টসের কাঁচামাল ছিল। তিনি বলেন, কতো কোটি টাকার পণ্য পুড়েছে তা প্রাথমিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে এটা নিশ্চিত। কেননা বিমানে জরুরি ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। কার্গো ভিলেজে মূল্যবান গুদামও রয়েছে। সেখানেও মূল্যবান পণ্য ছিল। বিমান বন্দরে কার্গো ব্যবস্থাপনা কবে চালু হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালে লেবাননের বৈরুত বন্দরের রাসায়নিকে আগুন লাগার পর ঢাকা কাস্টমস কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এনবিআর ও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) একাধিকবার চিঠি দিয়ে অগ্নিকা-ের ঝুঁঁকির কথা জানিয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরেও অস্ত্র, গোলাবারুদ সরিয়ে নিতে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, কার্গো ভিলেজের অবকাঠামো অনেক পুরনো। অগ্নিকা-ের ঘটনা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখানে নেই।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যার পর দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এ সময় তিনি জানান, আগুন যেখানে লেগেছে এর পুরোটাই আমদানি কার্গো, রফতানি কার্গো পুরোপুরি নিরাপদ রয়েছে। উপদেষ্টা বলেন, আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে, গতকাল (শনিবার) রাতের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা এবং বিমানবন্দর চালু করার ব্যবস্থা করা হবে। এদিকে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রিরা। বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, ফ্লাইটের অপেক্ষায় দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষে করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যাত্রীরা।
সূত্র মতে, হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উত্তর-পূর্ব অংশের কার্গো ভিলেজে আগুনের সূত্রপাত। জানা গেছে, ওই অংশে দেশের বাইরে থেকে আমদানি হওয়া পণ্য মজুদ করে রাখা হতো। তবে, কিভাবে আগুন লেগেছে সেটি এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। তবে আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত একজন ফায়ার ফাইটার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগুনের পাশাপাশি কার্গো ভিলেজের ওই অংশে থাকা কয়েকটি ড্রাম বিস্ফোরিত হতে দেখেছেন তিনি। আগুন নেভানোর সময় তীব্র ধোঁয়া ও প্রচন্ড গরমে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও জানান ওই ফায়ার ফাইটার।
ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, দুপুরের পর আট নম্বর গেইটের কাছে কার্গো ভিলেজ থেকে ধোঁয়া দেখতে পান তারা। এরপর দ্রুতই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। গণমাধ্যমে পাঠানো বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের একটি বার্তায় জানানো হয়েছে, দুপুর সোয়া দুইটার দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় আকস্মিকভাবে আগুনের ঘটনা ঘটে। তারা বলছে, ঘটনার পরপরই বিমানবন্দর ফায়ার সেকশন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফায়ার ইউনিট এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে সম্মিলিতভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কার্যক্রম শুরু করে।