
জুলাই সনদ স্বাক্ষর হয়েছে। এটি জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি। রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সনদ বাস্তবায়নে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়নি। শুধু স্বাক্ষরকারী দলগুলোর নৈতিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। ফলে আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নেই এর সাফল্য নিশ্চিত হবে।
যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। তাদের মতে, আইনি ভিত্তি আদায়ে যারা আন্দোলন করছে, তা যৌক্তিক। কারণ ক্ষমতায় গেলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে, এই বিশ্বাস অনেকের নেই। দলগুলোরও পারস্পরিক আস্থার অভাব রয়েছে। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা বলছে, বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হলে এই সনদ মূল্যহীন। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলছে, সনদ বাস্তবায়নে খুব শিগগিরই তারা সরকারকে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করবে। এ নিয়ে আজ রোববার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।
প্রসঙ্গত কোনো ধরনের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা ছাড়াই শুক্রবার জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল। আজ রোববার গণফোরাম স্বাক্ষর করবে। ফলে স্বাক্ষরকারী দলের সংখ্যা হবে ২৫। জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অংশীজন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, আইনি ভিত্তি ছাড়া এই চুক্তির কোনো মূল্য নেই। সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসও বলেছেন, বর্তমানে এটি কাগজ। এটি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। এ অবস্থায় বিভিন্ন বিশেষজ্ঞও সনদ বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, জুলাই সনদ খুব ভালো বিষয়। ইতোমধ্যে সনদ স্বাক্ষর হয়েছে। অনেকগুলো দল স্বাক্ষর করেছে। তবে এই সনদ এখন কাগজে রয়েছে। বাস্তবায়ন করলেই এর পূর্ণতা পাবে। সেক্ষেত্রে আইনি ভিত্তি নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছে, তা অত্যন্ত যৌক্তিক। কারণ আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি পারস্পরিক অবিশ্বাস আছে। দলগুলো অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়। ভোটারদের কাছে নানা প্রতিজ্ঞা করে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তা ভুলে যায়। তারা আগের প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়ন করে না। তার মতে, দলীয় সংকীর্ণতার কারণে রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতায় আসতে পারে না। আর রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে এই সমস্যার কারণেই দেশের এই অবস্থা।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে শিগগিরই এর আইনি ভিত্তির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হবে। জানতে চাইলে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি নিয়ে আমরা কাজ করছি। শনিবারও আমাদের বৈঠক হয়েছে। রোববারও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা হবে। এরপর আমরা বাস্তবায়নের ব্যাপারে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুপারিশ জমা দেব। রাজনৈতিক দলগুলোর আগের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা-এ প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন আমার জানা মতে, এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে আমরা আশাবাদী। এনসিপি সনদে স্বাক্ষর করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত আছে। জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলেন এনসিপি নেতারা। এরপর কমিশন গঠন করার পর থেকে তারা এই সনদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সবমিলিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে দলটির ভূমিকা অসামান্য। তাই দলটির সঙ্গে আমরা যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। আশা করি, স্বাক্ষর করবে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক যুগান্তরকে বলেন, বাস্তবায়ন বলতে কী বোঝানো হয়েছে, সে ব্যাপারে আমি পরিষ্কার নই। তবে প্রকল্প আর সর্বোচ্চ আইন বাস্তবায়ন এক নয়। তিনি বলেন, অনেকগুলো দল সনদে স্বাক্ষর করেছে। ফলে দলগুলোর একটি নৈতিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তাদের সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা যাবে। কিন্তু দলগুলো নির্বাচনি ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি থাকে, তার সবগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয় না। ফলে ক্ষমতায় গেলে দলগুলো এসব বিষয় কার্যকর করবে তা নিশ্চিত নয়। তিনি বলেন, এটি অবাস্তব বিষয়। জুলাই সনদ নিয়ে এক কথায় আমার মূল্যায়ন হলো-বাঁশের মই দিয়ে চাঁদে যাওয়ার মতো। কীভাবে বাঁশের মই দিয়ে চাঁদে যাওয়া যায়, এ নিয়ে ৬০ বছর বা তার বেশি সময়ও আলোচনা হতে পারে। কিন্তু চাঁদে যাওয়া সম্ভব নয়। তার মতে, সনদে অনেক কিছু আছে, যা সংবিধানপরিপন্থি। এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে। কারণ সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। এই আইনের পরিপন্থি যে কোনো আইন এমনিতেই বাতিল হয়ে যায়। সবগুলো দল স্বাক্ষর করলেও কী এর আইনি ভিত্তি দাঁড়াবে? প্রশ্ন রাখেন তিনি। পরবর্তী সরকারকে কার্যকর করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ শাহান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, জুলাই সনদে স্বাক্ষর হয়েছে। এটি একটি ডেভেলপমেন্ট। তবে আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন ছাড়া এটি উপকারী কিছু হবে না। তিনি বলেন, সনদ বাস্তবায়নে নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) একটা চ্যালেঞ্জ। যে বিষয়গুলো নোট অব ডিসেন্ট আছে, সেগুলোতে জনমত পক্ষে এলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার কীভাবে মূল্যায়ন করবে সেটি পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয়ত, গণভোটের কথা বলা হয়েছে। গণভোট হবে। তবে সেটি কীভাবে হবে, পরবর্তী সরকারের কাছে কী ধরনের সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকবে, তাও পরিষ্কার নয়। অর্থাৎ বাস্তবায়ন ইস্যুতে জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতাগুলো কাটাতে না পারলে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। তার মতে, আরও ১৫ দিন সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি জায়গায় আসতে হবে।