Image description
জমি অধিগ্রহণের ৮ কোটি টাকা পেতে ঘুস ১ কোটি

‘সাহাবুদ্দিন গাজীকে তারা বাঁচতে দিলেন না। একরকম জোর করেই ১ কোটি টাকা ঘুস নিয়ে গেছে চক্রটি। জমি অধিগ্রহণের ৮ কোটি টাকার চেক পাশ করাতে তার কাছ থেকে ডাকাতি স্টাইলে এই টাকা নেওয়া হয়।’ কথাগুলো বলছিলেন হতভাগ্য সাহাবুদ্দিনের (৭৫) এক নিকটাত্মীয়। অধিগ্রহণের অর্ধেক টাকা উত্তোলনের সময় এভাবে ঘুস নেওয়া এবং হয়রানির বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি বয়োবৃদ্ধ সাহাবুদ্দিন। বয়সের কারণে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ২৫ দিনের মাথায় ঘুমের মধ্যেই স্ট্রোক করে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মারা যান। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে নরসিংদী জেলায়। এখনো সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণের টাকা বকেয়া থাকায় ভুক্তভোগী পরিবার ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না।

এদিকে এ ঘটনায় যুগান্তরের মাসব্যাপী অনুসন্ধানে ঘুস লেনদেনের অকাট্য তথ্যপ্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। ডিসি অফিসের দালালরা ৬০ লাখ টাকার ঘুস নিয়েছে চেকের মাধ্যমে এবং ৪০ লাখ টাকা নেওয়া হয় নগদ। চেক ব্যাংকে জমা দিয়ে টাকা তুলে ভাগবাঁটোয়ারা করেছেন আমির হোসেন, যিনি ডিসি অফিসের এলএ শাখার দালালচক্রের অন্যতম ঘুস কালেক্টর। তার ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে ঘুসের টাকা তুলে নেওয়া হয়। আর এই টাকার ভাগ ডিসি, এডিসি (রাজস্ব), ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাসহ ঘুস চেইনের প্রত্যেকে পজিশন অনুযায়ী ভাগ পেয়ে থাকেন। ঘুস লেনদেনের রাজসাক্ষী হিসাবে সার্ভেয়ার আমির হোসেন যুগান্তরের কাছে অকপটে সব স্বীকার করেছেন। কীভাবে ঘুস লেনদেন হয়, ডিসিসহ ঘাটে ঘাটে কারা কত টাকা কাদের মাধ্যমে নিয়েছেন-সব ফাঁস করে দিয়েছেন। এমনকি তিনি জানান, এমন চিত্র শুধু নরসিংদী নয় চলমান এই প্রকল্পের ৭ জেলার ডিসি অফিসে কমবেশি একই অবস্থা বিরাজ করছে।

এদিকে যে প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ঘুস লেনদেনের চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা সামনে এসেছে, সেখানে আরও সাতটি জেলার সম্পৃক্ততা রয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, ঘুস-কমিশনের দরকষাকষি চূড়ান্ত না হওয়ায় ভুক্তভোগী বেশির ভাগ মানুষ তাদের প্রাপ্য টাকা তুলে নিতে পারছেন না। চাহিদামাফিক কমিশন দিতে না চাইলে দালালচক্র দিয়ে উলটো ভুয়া মামলা করে এলএ কেসে আটকে দেওয়া হচ্ছে। আলোচ্য প্রকল্পে ঘুস লেনদেনের প্রমাণ দেন নরসিংদীর সাবেক এডিসি অন্জন দাশ এবং জমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার আমির হোসেন। তারা দুজনই ডিসি, এডিসিসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে প্রতিবেদককে মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দিয়ে নিউজ থামাতে বলেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা-সিলেট করিডর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ১৬ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা সংস্থান রয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের তামাবিল পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণেই বরাদ্দ আছে ৮ হাজার ৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটির আওতায় ঢাকা-সিলেট অংশে ৭টি জেলায় ৮ একর ৩০ শতক জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৬৬টি এলএ কেসের মধ্যে মাত্র ৮টির দখল হস্তান্তর হয়েছে। চার বছরে এই প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ। নরসিংদী ছাড়া অপর ৬ জেলা হচ্ছে-নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট। ব্যয়বহুল এ প্রকল্পে ৩ হাজার ৬৭৩ কোটি ৮৯ লাখ ৮৬ টাকা সরকার বরাদ্দ দিয়েছে। বাকি ১৩ হাজার ২৪৪ কোটি ৬৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদে চলমান এই প্রকল্প জমি অধিগ্রহণের কারণে অগ্রগতি হচ্ছে না। ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একনেক সভায় ‘ঢাকা-সিলেট করিডর সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প’ অনুমোদিত হয়। এছাড়া মাধবদী থানা ভবন নির্মাণে এক একর ৯৯ শতক জমি অধিগ্রহণে ১৯ কোটি ২৯ লাখ টাকার প্রকল্পেও জমির মালিকদের ডিসি-এডিসির নামে ঘুস দিতে হয়েছে।

ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও লেনদেন : নথিপত্রে দেখা যায়, নরসিংদীর বাগহাটা মৌজায় শেভরন ফ্যাক্টরি অ্যান্ড মিলের ১৪ শতক জমির মধ্যে ৭ শতক ১৫/২০২১-২০২২ এলএ কেস নং-এর আওতায় অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। এই জমির মালিক সাহাবুদ্দিন গাজী। অবশিষ্ট ৭ শতক জমির মালিকানা নিয়ে আপত্তি থাকায় এখনো এর সমাধান হয়নি। ৭ শতক জমির দাম নিশ্চিত করতে দেখা যায় রোয়েদাদ ছাড়পত্রে। জমির মালিকানা সংক্রান্ত প্রমাণপত্রে ৬ জন কর্মকর্তার স্বাক্ষর দেখা যায়। গত বছরের ৪ এপ্রিল পর্যন্ত শেভরন ফ্যাক্টরির মালিকানায় ৭ শতক জমির দাম নির্ধারণ করা হয় ৮ কোটি ১৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৬ টাকা। নরসিংদীর তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মোস্তফা মনোয়ার, ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা চৌধুরী মুস্তাফিজুর রহমান, রেহানা মজুমদার মুক্তি, কানুনগো মো. আব্দুল জলিল, সার্ভেয়ার মুহা. আ. আজিজ ও সার্ভেয়ার ‘আমির হোসেন’ জমির দাম নির্ধারণী নথিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ওই বছরের ৮ আগস্ট আমির হোসেনের নামে ৬০ লাখ ১৮ হাজার টাকার পূবালী ব্যাংক নরসিংদী শাখার একটি চেক ইস্যু করা হয়। জমির মালিক সাহাবুদ্দিন গাজী নিজেই তৎকালীন ডিসির কমিশন বাবদ আমির হোসেনকে চেকটি লিখে দেন। আমির হোসেনের নামে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ৭৫৮৭৪৩৮ নম্বর অ্যাকাউন্টে এই টাকা ২০২৪ সালের ১১ আগস্ট জমা হয়।

জমি অধিগ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ‘সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে মোট এক কোটি টাকা ঘুস নেওয়া হয়েছে। ৮ কোটি ১৫ লাখ টাকার বিপরীতে এই টাকা কমিশন দিতে হয়েছে তাকে। আরও ৭ শতক জমির টাকা উত্তোলনের সময় তিনি নতুন করে কোনো ঘুস দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। এমন কথা বলার পর দালালচক্রের মাধ্যমে আপত্তিপত্র জমা দিয়ে টাকা উত্তোলন আটকে দেওয়া হয়। এসব কারণে সাহাবুদ্দিন গাজী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি মারা যান। ভুক্তভোগী নরসিংদী পৌর সদরের ২৯৫ পশ্চিম ব্রাহ্মনদীর বাসিন্দা। অবশিষ্ট টাকা না পাওয়ার হতাশা থেকে সাহাবুদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ সরাসরি অভিযোগ দিতে রাজি হচ্ছেন না।

অভিযোগ উঠছে, শুধু সাহাবুদ্দিন গাজী একা নন, যারা টাকা তুলেছেন, তাদের প্রত্যেককে এভাবে মোটা অঙ্কের ঘুস কমিশন দিতে হয়েছে। যারা টাকা দিতে রাজি হননি, তাদের ভুয়া অভিযোগ জমা দিয়ে ‘আপত্তি ফাঁদে’ ফেলে দেওয়া হয়েছে। এভাবে বহু মানুষের অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ আটকে রাখা হয়েছে।

ওই কর্মকর্তা যুগান্তরকে আরও বলেন, ‘ডিসি অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক ভূঁইয়া এই সিন্ডিকেটের প্রধান। তিনিই সব নিয়ন্ত্রণ করেন। এমনকি গত মঙ্গলবার সাক্ষাৎপ্রার্থী একজন নারীকেও শ্লীলতাহানি করেন এই ফারুক। তারপরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কারণ, তিনি ঘুসের কোটি কোটি টাকা সমন্বয় করেন। ফারুকের সেকেন্ড ইন কমান্ড হচ্ছেন সার্ভেয়ার আমির হোসেন। তিনি নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে অত্যন্ত সুকৌশলে আমির হোসেন নামে একজন দালাল রেখেছেন। ওই আমির হোসেনের নামেই কমিশনের চেক এবং টাকা ক্যাশ করা হয়। আরও কয়েকজন বিশ্বস্ত দালাল রেখে ঘুস কমিশনের টাকা কালেকশন ও ভাগবাঁটোয়ারা করা হচ্ছে।’

জানতে চাইলে সাহাবুদ্দিন গাজীর ছোট ছেলে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জিএম শরীফ যুগান্তরকে বলেন, ‘নরসিংদী এলএ শাখায় জমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত করতে কী পরিমাণ হয়রানি করা হচ্ছে, তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা মুশকিল। বৃদ্ধ বাবা মৃত্যুর আগে এমন হয়রানির বিষয়টি আমাদের কাছে কখনো বলেননি। বাবার মৃত্যুর পর এলএ শাখায় এসে অনেককে চোখের পানি ফেলতে দেখছি। এরপর আছে দালালদের উৎপাত, ভুয়া আপত্তি।’

তিনি বলেন, ‘৫০ বছর ধরে যে জমি ভোগদখলে ছিল, সেই জমির ওপর আপত্তি জানায় পূর্ববর্তী বিক্রেতার ওয়ারিশ। দফায় দফায় তদন্ত করে মালিকানা চূড়ান্ত করা হলেও রহস্যজনক কারণে সেসব আপত্তি আমলে নিয়ে মাসের পর মাস হয়রানি করা হয়। ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তার পাশাপাশি এই চক্রের সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয়ধারী কয়েকজন প্রতারকও আছে। যারা আপত্তি জানিয়ে আবার মীমাংসা করার প্রস্তাব দেয়। বাস্তবে এগুলো সব পাতানো ম্যাচ। এভাবে হয়রানি অব্যাহত থাকলে আমি হাইকোর্টে রিট করে প্রকল্পের স্থগিতাদেশ চাইতে বাধ্য হব।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাবার ব্যাংক স্ট্যাটমেন্ট দেখে জানতে পেরেছি আমির হোসেন নামে একজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চেকের মাধ্যমে ৬০ লাখ টাকা স্থানান্তর হয়েছে। এ বিষয়ে বিদায়ি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ আহমেদ তদন্তও করেছিলেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন।’

ঘুসের রাজসাক্ষী সার্ভেয়ার আমির : চলমান এই প্রকল্পে কে কীভাবে জমি অধিগ্রহণের টাকা পেয়েছেন, এর চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন নরসিংদী এলএ শাখার সার্ভেয়ার মো. আমির হোসেন। শনিবার যুগান্তর কার্যালয়ে এসে প্রতিবেদককে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট ডিসি-এডিসিসহ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগকারী একজনের মাধ্যমে প্রতিবেদককে ‘মোটা অঙ্কের’ টাকা দিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে সবকিছু খোলাসা করেন তিনি। ঘুস লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জমির শ্রেণিভেদে কমিশনের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত তারা আলোচনায় মীমাংসা করতে পারেন। ১০ লাখের বেশি গেলেই সরাসরি জেলা প্রশাসকের নিজস্ব দালালের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সেখানে আমাদের হাত থাকে না।’ একপর্যায়ে আমির হোসেন সবকিছু স্বীকার করে বলেন, ‘আপনার কাছে এসেছি। মারলে মারেন। বাঁচালে বাঁচান। মোট কথা, আমরা তো ছোট চাকরি করি। ডিসি স্যারদের পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ করা সম্ভব না। তবে এ কথা সত্য যে, এসব কমিশনের টাকা লেনদেনের সঙ্গে বড়জোর আমরা এলএও স্যার থেকে শুরু করে এডিসি রেভিনিউ পর্যন্ত যোগাযোগ করতে পারি। ধরে নেন সেরকম কিছু করেছি। আর ডিসিরা তো বড় অফিসার। ওনারা এসব কমিশনের ভাগ নিতে ভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেন।’

আমির হোসেন আরও জানান, নিরবচ্ছিন্ন লেনদেন করতেই গণ-অভ্যুত্থানের আগে নরসিংদীতে কর্মরত ডিসি বদিউল আলম নিজেই ফারুক ভূঁইয়াকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবে এলএ শাখায় নিয়ে আসেন। ফারুক নরসিংদীর স্থানীয় বাসিন্দা। জমি অধিগ্রহণের জন্য ডিসির কমিশনের পুরো টাকাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অন্জন দাশ ও এই ফারুক ভূঁইয়া। সদ্যবিদায়ি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী খুব কম কাজ করেছেন। তবে বেশি টাকা নিয়ে গেছেন ডিসি ড. বদিউল আলম ও আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান। সাহাবুদ্দিন গাজীর কাছ থেকে নেওয়া কমিশনের এক কোটি টাকা বদিউল আলমের আমলেই নেওয়া হয়েছে। আমির হোসেন নামে যে দালালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এই টাকা লেনদেন হয়েছে, সেটি ডিসি বদিউল আলম স্যারের কমিশনের টাকা। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল হাসানও জমি অধিগ্রহণের মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন।’

ড. বদিউল আলম বর্তমানে চট্টগ্রামে উপ-ভূমি সংস্কার কমিশনার (উপসচিব) হিসাবে কর্মরত। ২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি নরসিংদীর ডিসি ছিলেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে ্রএ ধরনের টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন চৌধুরী ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নরসিংদীর ডিসি ছিলেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘নরসিংদীতে থাকাবস্থায় আমার নামে কোনো কমিশন আদায় নিষেধ করে দেওয়া হয়। সাহাবুদ্দিন গাজীর কাছ থেকে নেওয়া টাকার বিষয়ে কোনো তদন্ত করেছিলাম কি না মনে পড়ছে না।’

আমির হোসেনের দেওয়া তথ্যমতে, ‘ম’ আদ্যাক্ষরের কর্মকর্তা ২০২১ সালের ৩১ মে থেকে ২৭ মাস নরসিংদীর ডিসি থাকাবস্থায় জমি অধিগ্রহণ থেকে সবচেয়ে বেশি ঘুস লেনদেন হয়। তখন তিনি আওয়ামী লীগের আমলে প্রভাব বিস্তার করে ভয় দেখাতেন। নরসিংদীতে বদলি হওয়ার আগে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপসচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেনেরও পিএস ছিলেন। জমি অধিগ্রহণে ঘুস-দুর্নীতিতে তার নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। এরপর খুদে বার্তারও কোনো জবাব না দিয়ে উলটো প্রভাবশালী মহলের দ্বারস্থ হন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল হাসান বলেন, ‘বর্তমানে আমি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আছি। নরসিংদীতে সাড়ে তিন থেকে ৪ মাস অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হিসাবে কর্মরত ছিলাম। আমার এই সময়ে এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়।’

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অন্জন দাশ বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসাবে অর্থ বিভাগের অধীন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ ও গ্রাহক সেবা)। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অন্জন দাশ শনিবার যুগান্তর কার্যালয়ে চলে আসেন। এ সময় তিনি প্রতিবেদককে জানান, ‘আলোচ্য জমি অধিগ্রহণে ভুলত্রুটি ক্ষমা করে নিউজ বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট ডিসি, এডিসিসহ সবার পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার ব্যবস্থা করবেন।’ ঘুস না খেলে টাকা দেবেন কোথা থেকে জানতে চাইলে বলেন, সবাই মিলে দিব আরকি। বুঝেনই তো, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের এই সময়ে পদোন্নতিসহ নানা জটিলতায় আছেন স্যাররা।’

দালাল আমির হোসেন বলেন, ‘সাহাবুদ্দিন গাজী ৬০ লাখ টাকা আমাকে দিয়েছেন। এটা ঠিক। ভাতিজা হিসাবে তিনি আমাকে দিয়েছেন। এটা ঘুস নয়।’ তবে আমির হোসেনের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই জানিয়েছেন সাহাবুদ্দিন গাজীর ছেলে জিএম শরীফ।

অপরদিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক ভূঁইয়ার নম্বরটি বন্ধ পাওয়ায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

হয়রানির নমুনা : নরসিংদীর কাওছার মিয়া ও আবুল কালাম নামে দুই ভুক্তভোগীর অভিযোগ থেকে জমির ক্ষতিপূরণ থেকে কীভাবে ঘুস আদায় করা হয়, এর একটি নমুনা পাওয়া যায়। ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে মো. আবুল কালাম বলেন, নরসিংদী এলএ শাখার সার্ভেয়ার আমির হোসেন ও সাইফুল ইসলামের ঘুসের প্রস্তাবে তারা অতিষ্ঠ। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে মাহমুদাবাদ মৌজায় ২০০৮ সাল থেকে তার একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে তিন তলাবিশিষ্ট বিল্ডিং। জমিটির আরএস দাগ-২১৬০। এলএ কেস নং-১৪/২০২১-২০২২। দোকান ঘরটির দৈর্ঘ্য ৩৫ ফুট এবং প্রস্থ ১৯ ফুট। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি অধিগ্রহণের আওতায় আসার পর নরসিংদী এলএ শাখা থেকে দালাল সঙ্গে নিয়ে দুইজন সার্ভেয়ার মো. আমির হোসেন ও মো. সাইফুল ইসলাম প্রায় সময়ই আসতেন। আলোচনাকালে তারা প্রস্তাব দেন ক্ষতিপূরণের মোট টাকা থেকে ৪০% তাদের দিয়ে দিতে হবে। চেক পাশ হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে এই টাকা ক্যাশ চেক হিসাবে দিতে হবে। নগদ টাকা ব্যাংক থেকে তুলে দেওয়ার পর চেক ফেরত দেওয়া হবে। তিনি এ প্রস্তাবে রাজি না হলে তাকে ধমক দিয়ে বলা হয়, ‘আরে ব্যাটা তুমি কি তোমার টাকা দিচ্ছ? আমরা তো ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্ক সিস্টেম করে বাড়িয়ে দিচ্ছি। আমাদের প্রতিবেদনের ওপর সবকিছু নির্ভর করবে। আমরা ভেটিং করে যা লিখে দেব, ডিসি স্যার তাই ফাইনালি অনুমোদন করবেন। এবার বুঝতে পারছ। আর যদি কমিশনের টাকা না দাও, তাহলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকবা, টাকা আর পাবা না। তোমাকে উলটো জমির মালিকানা প্রমাণ করা নিয়ে একের পর এক অভিযোগ ফেস করতে হবে।’

নরসিংদীর মরজাল এলাকার কাওছার মিয়া ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট মহাসড়কের পাশে তারও একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে সেটি দোতলা বিল্ডিং। মরজাল মৌজার আরএস দাগ-৯১৬২, এলএ কেস নং-১২/২০২১-২০২২। তার বিল্ডিংটির দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট এবং প্রস্থ ৪৫ ফুট। তার সঙ্গেও চুক্তি করতে বলেন ওই দুই সার্ভেয়ার। প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পেতে ৪০ লাখ টাকা কমিশন দাবি করেন তারা।’

ঘুসখোরদের দম্ভোক্তি : যুগান্তরের রিপোর্ট বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে ঘুসচক্রের একজন মোবাইল ফোনে কল করে বলেন, ‘দেখেন, এলএ শাখায় কী হয়, সবাই জানে। কিন্তু এভাবে রিপোর্ট করে কোনো লাভ হবে না। আদালতে ঘুস নেওয়ার বিষয়টি কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। মাঝখানে সমাজে স্যারদের সম্মানটা যাবে। ডিসি স্যাররা তো কানতাছে, দেখেন ভাই কিছু করা যায় কি না।’