
কক্সবাজার জেলার সীমান্তপথ দিয়ে মায়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে ইউরিয়া সার উদ্বেগজনক হারে পাচার করা হচ্ছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে উখিয়ায় দুই ডিলারের গুদাম থেকে স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে ৬০৭ বস্তা সার। এসব সার মায়ানমারে পাচারের জন্য রাখা হয়েছিল। এভাবে সরকারের বরাদ্দ করা সার মায়ানমারে পাচার হওয়ায় স্থানীয় বাজারে সারের তীব্র সংকট দেখা দিচ্ছে।
জানা গেছে, বেশির ভাগ ডিলারের সঙ্গে সারপাচারে যুক্ত রয়েছেন সীমান্তবর্তী কিছু সদস্য—তাঁদের বড় অংশ আবার রোহিঙ্গা শ্রমিক।
জানা গেছে, কক্সবাজার জেলায় রয়েছে ১৬৮ জন সার ডিলার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন-বিএডিসি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন-বিসিআইসির মাধ্যমে ৮৪ জন করে ডিলার নিয়োগ করা হয়।
সবচেয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সরকারিভাবে নিয়োজিত স্থানীয় সার ডিলারদের বিরুদ্ধে। কক্সবাজার জেলায় এমন ডিলারও রয়েছেন, যিনি বিসিআইসি ও বিএডিসি উভয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই ডিলার নিযুক্ত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তা সম্পূর্ণ অবৈধ। একই ব্যক্তি সরকারি দুই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিযুক্ত হয়ে দ্বিগুণ পরিমাণে সার বরাদ্দ পাচ্ছেন। তার দ্বিগুণ বরাদ্দের সারের অর্ধেক পাচার করে দেওয়া হচ্ছে মায়ানমারে।
স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুসারে, মায়ানমারে সার পাচার করা হচ্ছে কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের কমপক্ষে ছয়টি পথ দিয়ে। মায়ানমার বাহিনীর সঙ্গে দেশের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘাতের পর রাখাইন রাজ্য এক প্রকার বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এরপর সেখানে কক্সবাজার থেকে সার পাচারের ঘটনা বেড়ে গেছে। সূত্র জানায়, ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ইউরিয়া সারের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্য এক হাজার ৩৫০
টাকা। আর রাখাইনে এই সারের দাম হচ্ছে বাংলাদেশি মুদ্রায় কমপক্ষে আড়াই হাজার টাকা। অর্থাৎ এক বস্তা সার রাখাইনে পাচার করতে পারলেই এক হাজার ২৫০ টাকা (প্রায় দ্বিগুণ) লাভ হয়। এ রকম দ্বিগুণ লাভের লোভে সরকারের নিয়োজিত ডিলাররা বাংলাদেশের কৃষকের জন্য সরকারের ভর্তুকি দেওয়া সার পাচার করে দিচ্ছেন।
সূত্র জানায়, গত ৯ অক্টোবর রাতে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশ ও কৃষি কর্মকর্তাদের যৌথ অভিযানে উখিয়া উপজেলা সদরের দক্ষিণ স্টেশনের এস কে অটো রাইস মিলে অভিযান চালিয়ে ২১৭ বস্তা সার জব্দ করা হয়েছে। এই সার মায়ানমারের রাখাইনে পাচার করার জন্য মজুদ করে রাখা হয়েছিল বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। অভিযানের আগে আরো ৭৩ বস্তা সার পাচার করে দেওয়া হয়। অভিযানকালে সারের ডিলার মেসার্স এস কে অটো রাইস মিলের মালিক আহমেদ কবির পালিয়ে যান। তিনি উখিয়া উপজেলা সার ডিলার সমিতির সাধারণ সম্পাদকও।
এর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর উখিয়ার কোট বাজার ভালুকিয়া সড়কে বিসিআইসির নিযুক্ত ডিলার জাহেদুল আলমের গুদাম থেকে ৩৯০ বস্তা সার জব্দ করে উপজেলা প্রশাসন। ডিলার জাহেদুল আলম দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমারে সার পাচার করে আসছিলেন বলে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের কাছে খবর ছিল। উখিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ জিয়াউল হক জানিয়েছেন, উপজেলা প্রশাসনের সমন্বিত অভিযানে উদ্ধার করা দুই ডিলারের সার নিরাপদ হেফাজতে রাখা হয়েছে। দুটি ঘটনায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ডিলারদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে সার পাচারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মেসার্স ফজল কবির সওদাগর নামের প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সার ডিলার সাহেদুল হক। তিনি জানান, ‘আমি বিসিআইসির মাধ্যমে নিয়োজিত সার ডিলার। প্রতি মাসে অল্প সার বরাদ্দ পাই। এত স্বল্প পরিমাণের সার পাচার করে আমার পোষাবে না। ডিলারদের সবাই সার পাচারে জড়িত এমন অভিযোগ ঠিক না। তবে সীমান্ত এলাকার কিছু মানুষ এ কাজে জড়িত থাকতে পারে।’ উখিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামানাশীষ সরকার বলেন, মায়ানমারে পাচারের কারণে স্থানীয় বাজারে সারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। আবার সংকটের ফলে দামও বেড়ে যায়। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচও বাড়ছে। সব মিলিয়ে বিপাকে পড়েন হতভাগ্য কৃষকরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নিয়োগ প্রাপ্ত এসব সার ডিলার দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তের চোরাইপথে রাখাইনে সার পাচার করে আসছেন। প্রতি কেজি সরকারি মূল্য স্থানীয় বাজারে ২৭ টাকা হলেও কৃত্রিম সংকটের কারণে ৪০ টাকা দিয়েও কৃষকরা সার পান না। অন্যদিকে রাখাইনে পাচার করে ডিলাররা পেয়ে থাকেন কেজিতে ৫০ টাকা।
কক্সবাজার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক ড. বিমল কুমার প্রামাণিক কালের কণ্ঠকে জানান, কক্সবাজার জেলায় ১৬৮ জন সারের ডিলার রয়েছেন। উখিয়ায় ৯ জন ও টেকনাফ উপজেলায় রয়েছে ৯ জন। প্রতি মাসে জেলায় ৯০ থেকে ১০০ টন করে সারের বরাদ্দ দেওয়া হয়। উখিয়ার ডিলার জাহেদুল আলমের বিরুদ্ধে সার পাচারের মামলা দায়ের হওয়ায় এরই মধ্যে তাঁর নামে সারের মাসিক বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্য ডিলার আহমদ কবিরের বিরুদ্ধেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তিনি জানান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিএডিসি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ শিগগিরই কৃষকবান্ধব সার বিপণণব্যবস্থা ঘোষণা করতে যাচ্ছে।