
ইংরেজিতে অকৃতকার্যের ধাক্কা লেগেছে এবারের উচ্চমাধ্যমিকের (এইচএসসি) সার্বিক পাশের হারে। এগারো শিক্ষা বোর্ডে এ বিষয়ে ফেল করেছে ৩৪ দশমিক ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। এটি গত বছরের চেয়ে বেশি। বিভাগ বিচারে বিজ্ঞানে ২১ শতাংশ, বাণিজ্যে ৪৪ শতাংশ এবং মানবিকে প্রায় ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এসবের প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলের ওপর। গত ২১ বছরে এবার পাশের হার সবচেয়ে কম। ২০০৫ সালে এইচএসসিতে এটি ছিল ৫৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। এরপর থেকে প্রতিবছরই পাশের হার বেড়েছে বা সামান্য কমবেশি হয়েছে। কিন্তু এবার তাতে বড় বিপর্যয় নামল।
নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এইচএসসি, মাদ্রাসা বোর্ডের আলিম এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (বিএম)-সবমিলিয়ে ১১ বোর্ডের পরীক্ষার ফল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়। এতে সর্বমোট পাশের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এটি গত বছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। শুধু পাশের হারই সর্বনিম্ন নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও দুই দশকের মধ্যে কম। এবার ৬৯ হাজার ৯৭ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। সেই হিসাবে জিপিএ-৫ কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪টি। তবে এবারও ছাত্রীরা বেশ ভালো করেছে। ছাত্রদের চেয়ে ৫৯ হাজার ২৩২ জন ছাত্রী বেশি পাশ করেছে। একইসঙ্গে ৪ হাজার ৯৯১ জন ছাত্রী বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে। এবার সবচেয়ে বেশি পাশের হার মাদ্রাসা বোর্ডে ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে কুমিল্লা বোর্ডে। পাশের হার ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
পাশের হার ও জিপিএ-৫ ভয়াবহ কমে যাওয়ার পেছনে পরীক্ষার হলে এবং খাতা মূল্যায়নে ‘কড়াকড়ি’কে বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, ‘এতদিন ফল ভালো দেখাতে গিয়ে শিক্ষার প্রকৃত সংকট আড়াল করা হয়েছে। এই ফলের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই দায়িত্ব এড়াতে পারে না। এবারের ফলকে আমরা ব্যর্থতা নয়, বরং আত্মসমালোচনার সুযোগ হিসাবে দেখছি। ফল কেন খারাপ হলো তা পর্যালোচনা করে খুঁজে বের করা হবে। শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের জন্য এবার প্রাপ্য নম্বরই দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এই ফলাফল আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আমরা অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি নয়, বরং ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততাকে বেছে নিয়েছি। আমরা এমন এক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলাম যেখানে সংখ্যাই সত্য হয়ে উঠেছিল।’
পাশের হার হ্রাসের পেছনে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা অনেকেই শিক্ষা উপদেষ্টার মতোই বলেছেন। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বলেন, সরকার এ বছর চেয়েছে, যেন মেধার মূল্যায়ন হয়। তাই প্রশ্ন ও খাতা দেখার ধারা পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে সামগ্রিক ফলাফল খারাপ হলেও প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন হয়েছে। প্রশ্নের ধরন বুঝতে একটু সমস্যা হয়েছে। তবে আগে থেকে জানালে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নিতে আরও সহজ হতো।
ফল বিশ্লেষণে পাশের হার কমে যাওয়ার পেছনে আরও দুটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। একটি হচ্ছে, মানবিকে পাশের হার কমে যাওয়া। এ বছর বিজ্ঞান, মানবিক এবং বিজনেস স্টাডিজ-এ তিন বিভাগে বিষয়ভিত্তিক পাশের হার কম। তবে মানবিক বিভাগে যেন বিপর্যয়ই নেমেছে। প্রায় ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক খারাপ ফল। এবার মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। এরমধ্যে পাশ করেছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এদের বেশিরভাগই গ্রামাঞ্চলের এবং সুবিধাবঞ্চিত অভিভাবকের সন্তান বা কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফল বেশি খারাপ হয়েছে। সমৃদ্ধ অঞ্চলের (শহর) ফল স্বাভাবিকভাবেই ভালো হয়। তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষা বোর্ড থেকে নম্বর বাড়ানো বা কমানোর ব্যাপারে পরীক্ষকদের কোনো নির্দেশনা ছিল না। ফলে শিক্ষার্থীরা যা লিখেছে, সেটারই সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে। আর পরীক্ষকদের দেওয়া নম্বরগুলো শুধু আমরা কম্পাইলড করেছি, ফল প্রস্তুত করেছি। এটাই রিয়েল (বাস্তব) ফলাফল’।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় নিজ নিজ বোর্ডে ফল প্রকাশ করা হয়। এদিন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে ফলাফলের সার-সংক্ষেপ তুলে ধরেন বোর্ডটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির। এরপর সাড়ে বেলা ১১টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার। এরমধ্যে শিক্ষার্থীরা কলেজ মাদ্রাসায় গিয়ে ফল জানতে পেরেছে। এছাড়া অনলাইন এবং এসএমএসেও শিক্ষার্থীরা ফল জেনেছে।
এবার নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে পাশের হার ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৩ হাজার ২১৯ শিক্ষার্থী। অপরদিকে মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডসহ ১১ বোর্ডে মোট পাশের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬৯ হাজার ৯৭ শিক্ষার্থী।
ঢাকা বোর্ডে পাশের হার ৬৪ দশমিক ৬২ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৬ হাজার ৬৩ জন, বরিশাল বোর্ডে ৬২ দশমিক ৫৭ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৬৭৪ জন, চট্টগ্রামে ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ হাজার ৯৭ জন, কুমিল্লায় পাশের হার ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ হাজার ৭০৭ জন, রাজশাহীতে ৫৯ দশমিক ৪০ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ১০ হাজার ১৩৭ জন, সিলেট বোর্ডে ৫১ দশমিক ৮৬ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৬০২ জন, দিনাজপুরে ৫৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ হাজার ২৬০ জন, ময়মনসিংহে ৫১ দশমিক ৫৪ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ হাজার ৬৮৪ জন ও যশোরে ৫০ দশমিক ২০ শতাংশ আর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫ হাজার ৯৯৫ জন। এই নয়টি বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৪২জন। এছাড়া মাদ্রাসা বোর্ডে পাশের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। এই বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ পরীক্ষার্থী। এতে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৮২ হাজার ৮০৯ জন। কারিগরি বোর্ডে পাশের হার ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ হাজার ৬১০ শিক্ষার্থী। এতে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ৬১০ জন।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোতে ইংরেজিতে গড়ে ৩৪ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এ বিষয়ে বেশি পাশের হার বরিশাল বোর্ডে, ৭৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম যশোর বোর্ডে ৫৪ দশমিক ৮২ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন পাশের হার হিসাববিজ্ঞানে, গড় ৭১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২৮ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে বোর্ডগুলোর পাশের হার তৃতীয় সর্বনিম্ন। এতে ১৮ প্রায় ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। এরপরে রয়েছে যুক্তিবিদ্যা, পাশের হার ৮৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ। আর পদার্থ বিজ্ঞানে পাশের হার ৮৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এছাড়া ১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে কুমিল্লা বোর্ডে। পাশের হার ৪৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এই বোর্ডে ইংরেজিতে পাশের হার ৬৫ দশমিক ২৮ শতাংশ, যা সারা দেশে তৃতীয় সর্বনিম্ন।
২১ বছরে সর্বনিম্ন ফল : বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যানুসারে, ২০০৫ সালে এইচএসসিতে পাশের হার ছিল ৫৯ শতাংশের বেশি। ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬৪ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৬৪ শতাংশের ওপরে, ২০০৮ সালে প্রায় ৭৫ শতাংশ হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে তা কমে যায় ৭০ দশমিক ৪৩ শতাংশে। এর পরবর্তী বছরগুলোয় পাশের হার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। শুধু তিন বছর (২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৮) ৭০ শতাংশের নিচে নেমেছিল।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সরাসরি পরীক্ষা হয়নি, ফলে ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ সবাই উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০২১ ও ২০২২ সালে ভিন্ন পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় পাশের হার ছিল এক বছর ৮৪ শতাংশের বেশি, আরেক বছর ৯৫ শতাংশের বেশি। কিন্তু ২০২৩ সালে তা আবার ৮০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। অপরদিকে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, মোট পাশের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
চারটির তিন সূচকই নিম্নগামী : ভালো ফলের সূচক হিসাবে চারটি দিক ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে-পাশের হার, মোট জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শতভাগ ও শূন্য পাশ করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। এবার চারটিই নিম্নমুখী। এ বছর ১১ বোর্ডে মোট পাশের হার গত বছরের চেয়ে কম। কমেছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অপরদিকে গত বছর শতভাগ পাশ করা কলেজ ও মাদ্রাসা ছিল ১ হাজার ৩৮৮টি, এবার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪৫টিতে। গত বছর শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৫টি, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০২টিতে। এই চার সূচকের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক ফলে।
এইচএসসির ফল চ্যালেঞ্জে আবেদন শুরু আজ : এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় যারা ফেল করেছেন বা কাঙ্ক্ষিত ফল পাননি, তাদের জন্য ফল চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ রয়েছে। ফল পুনঃনিরীক্ষণের তাদের আবেদন আজ থেকে শুরু হবে। চলবে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রতি পত্রের ফল পুনঃনিরীক্ষার ফি ১৫০ টাকা।