
চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে প্রস্তুত করা হয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’। অন্তর্বর্তী সরকারের মতে, এটি হতে যাচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতার নতুন দলিল। এই দলিলের ওপর ভিত্তি করে শুরু হবে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা। বহুল প্রত্যাশিত সেই সনদ আজ শুক্রবার স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা।
এই সনদে স্বাক্ষরের জন্য ডাক পেয়েছেন দেশের ৩০টি রাজনৈতিক দলের ৬০ জন প্রতিনিধি। এরই মধ্যে দলগুলো তাদের প্রতিনিধিদের নাম কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও এই সনদে স্বাক্ষর করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও সদস্যরা।
তবে এই সনদে শেষ পর্যন্ত দেশের কয়টি দল স্বাক্ষর করবে তা গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চার বাম দল এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তারা এই সনদে স্বাক্ষর করবে না এবং অনুষ্ঠান বয়কট করবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, তাদের প্রস্তাব না মানলে স্বাক্ষর করবে না।
পরেও স্বাক্ষরের সুযোগ থাকবে : গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কমিশন মনে করে, জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া প্রয়োজন।
রূপরেখা দেবে কমিশন। আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ পাঠাবে এবং সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে বলে কমিশন আশাবাদী।
তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পরবর্তী সংস্কার ও রাজনৈতিক সনদ প্রণয়নে এনসিপির অবদান আছে। তাই কমিশন আশা করছে, এনসিপি জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আসবে এবং স্বাক্ষর করবে। কমিশন বলে, ‘ঐতিহাসিক মুহূর্তে সবার উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। আমরা আশা করছি, সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে উপনীত হতে পারব। তবে কোনো দল যদি মনে করে যে পরে স্বাক্ষর করবে, তবে সেটাও করতে পারে। তাদের জন্য দরজা খোলা থাকবে।’
মতভিন্নতা থাকবে, আবার সব দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করলে সনদের ভবিষ্যৎ কী—এমন প্রশ্নের উত্তরে আলী রীয়াজ বলেন, ‘এটি হাইপোথিক্যাল বিষয়। সনদে স্বাক্ষর করাটা একটি ডকুমেন্ট।’ বাম দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে বলেও প্রত্যাশা করেন তিনি।
বিএনপি প্রস্তুত
জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত বিএনপি। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা গতকাল রাজধানীর বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে যান। অবশ্য আগেই বিএনপি সনদে স্বাক্ষরে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘গণভোট আগে না পরে, এটি জাতীয় সনদের কোনো বিষয় নয়। বাস্তবায়নের জন্য ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে সুপারিশ দেবে। আমরা মনে করি, দ্রুত সনদ স্বাক্ষর করে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। বিএনপি শুরু থেকে বলছে, যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। সেই কাজটি যাতে বিলম্বিত না হয়, সেটি দেখা জরুরি।’ এ কাজে সবার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
জামায়াত যা বলছে
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামী অংশ নেবে। তবে সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি—গত বুধবার এমনটা জানিয়েছেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। গতকাল তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা ভেবেছি, আমাদের প্রয়োজনীয় যেসব সমস্যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, তার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে, সেগুলো আলোচনার ভিত্তিতে সমাধানের কোনো সুযোগ যদি আমরা দেখি, তাহলে আমাদের এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি থাকবে না। আমরা আমন্ত্রণ পেয়েছি, কিন্তু আমরা চিন্তা করছি, আমরা কাল কী ভূমিকা রাখব।’
তিনি আরো বলেন, গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। নভেম্বরই গণভোটের উপযুক্ত সময়।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে সংশয় রয়েছে। গণভোটের মাধ্যমে সনদের আইনি ভিত্তি দিতেই হবে। গণভোটে বাধা দিলে বিএনপির অবস্থা আওয়ামী লীগের মতো হবে।
এনসিপি শর্ত দিয়েছে
আদেশ জারিসহ তিনটি শর্ত না মানলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে জানান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও ন্যারেটিভ স্থান পায়নি এবং পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখানো হয়নি। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া দেখেই সনদে স্বাক্ষর করবে এনসিপি। গণমানুষের দাবি পূরণ ছাড়া জুলাই সনদ স্বাক্ষর করা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। তিনি আরো বলেন, ‘ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচন কমিশনের জন্য আমাদের কার্যক্রম আটকে রয়েছে।’
এনসিপির দেওয়া শর্তে বলা হয়েছে, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের টেক্সট এবং গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে আগেই জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদে রায় দেয়, তবে নোট অব ডিসেন্টের কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। গণভোটের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত গাঠনিক ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে। সংস্কারকৃত সংবিধানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬’।”
স্বাক্ষর করবে না চার বাম দল
জুলাই সনদে সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ জাসদ স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছে চার বাম দল। গতকাল বিকেলে রাজধানীর মুক্তি ভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক হোসেন, বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, সিপিবির সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন এবং সম্পাদক নিখিল দাস, বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বাবু, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবীর জাহিদ প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সনদের পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত না হওয়া, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির পরিবর্তন, ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বাতিলের যে প্রস্তাব সনদে উল্লেখ রয়েছে, তা সংশোধন না হলে এই চার দলের পক্ষে সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব নয়। সনদ স্বাক্ষরের আগে যদি কমিশনের পক্ষ থেকে উপরোক্ত বিষয়গুলো সংশোধন করা হয় এবং নোট অব ডিসেন্ট বাদে সর্বসম্মত বিষয় নিয়ে সনদ চূড়ান্ত করা হয় তাহলে চারটি দল সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত রয়েছে। যেসব বিষয়ে দলগুলো কমিশনের প্রস্তাবে একমত হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে জাতির কাছে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে নির্বাচন পেছানোর যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় দেশবাসীকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান নেতারা।
জুলাই সনদে যা থাকছে
জুলাই সনদের খসড়া কপি রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া হয়েছিল গত ১১ সেপ্টেম্বর। সেটিই চূড়ান্ত করে গত মঙ্গলবার রাতে দলগুলোকে দেওয়া হয়। সাত দফা অঙ্গীকারনামার ভিত্তিতে প্রণীত ৪০ পৃষ্ঠার এই সনদের তিনটি ভাগের মধ্যে প্রথম ভাগে পটভূমি, দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব ও তৃতীয় ভাগে সনদ বাস্তবায়নের সাত দফা অঙ্গীকার রয়েছে। এই সনদের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৪৭টি বিষয়কে ‘সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে সংস্কার’ এবং বাকি ৩৭টি বিষয়কে ‘আইন বা অধ্যাদেশ, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্কার’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ঐকমত্য কমিশন। জুলাই সনদের পটভূমি ব্যাখ্যা করে সংস্কারযজ্ঞ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রমসহ সংস্কারের ৮৪ দফা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো কী অঙ্গীকার করছে, তা উল্লেখ করার পর স্বাক্ষরের জায়গা রাখা হয়েছে।
সংবিধান সংস্কার করে বাস্তবায়িত বিষয়ের মধ্যে বাংলার পাশাপাশি অন্য ভাষার স্বীকৃতি, বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয়, সংবিধান সংস্কারের বিধান, সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধের অনুচ্ছেদ বাতিল এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের বিধান সংযুক্তি, মৌলিক অধিকারের তালিকা সম্প্রসারণ, উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্টকরণ, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়ায় সংশোধন এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে মামলার বাদী বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সম্মতি নেওয়ার বিধান যুক্ত করার কথা রয়েছে।
সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পর্কিত অংশে প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকার সীমা, প্রধানমন্ত্রীর দলীয় প্রধানের পদে না থাকা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার গঠন প্রক্রিয়া, কার্যাবলি ও মেয়াদ প্রভৃতি বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করা হবে। একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গঠন নিয়ে ৩০টি দল ও জোট একমত পোষণ করলেও প্রধানমন্ত্রী পদে দলীয় প্রধানের থাকা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ও গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্নমত ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে।
আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার ক্ষেত্রে ২৫টি রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। পাঁচটি দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত ভোটে উচ্চকক্ষ গঠনের যে প্রস্তাব জাতীয় ঐকমত্য কমিশন করেছে, তাতে ২৪টি রাজনৈতিক দলকে একমত হতে দেখা যাচ্ছে। আর সেখানে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে বিএনপিসহ সাতটি রাজনৈতিক দলের। উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচন পদ্ধতি ও এখতিয়ার অংশে উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা, উচ্চকক্ষের সদস্যদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা, জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ১০০ জন করা, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্বাচন, ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি আইনসভায় অনুমোদনের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে অস্থায়ী বিশেষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে অনধিক ১০ বছর পর সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।
বিচারব্যবস্থা অংশে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, সুপ্রিম কোর্টের প্রয়োজনীয়সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গঠন ও এই কমিশনকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে শক্তিশালীকরণ, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরি নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টকে দেওয়া এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাছাই কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং তাদের কাজের ক্ষেত্রে যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব জুলাই সনদে রাখা হয়েছে, তাতে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট একমত পোষণ করেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিধান হিসেবে ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশন এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংস্কারের অঙ্গীকারও থাকছে জুলাই সনদে। সনদে দুর্নীতি দমন কমিশনকে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। আইন বা অধ্যাদেশ, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়সমূহের মধ্যে প্রথমে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৮(৫) সংশোধনসাপেক্ষে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংসদের কমিটিসমূহ ও সদস্যদের বিশেষ অধিকার, অধিকারের সীমা এবং দায় নির্ধারণের অঙ্গীকার থাকছে জুলাই সনদে।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সীমানা পুনর্নির্ধারণে আইন প্রণয়ন, বিচারকদের জন্য অবশ্য পালনীয় আচরণবিধি, সাবেক বিচারপতিদের জন্য অবশ্য পালনীয় আচরণবিধি, সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠন, বিচার বিভাগের জনবল বৃদ্ধি, জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থাকে অধিদপ্তরে রূপান্তর, বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ দাখিল, আদালত ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও ডিজিটাইজ করা, আইনজীবীদের আচরণবিধিসংক্রান্ত বিষয় রাখা হয়েছে আইন বা অধ্যাদেশ, বিধি ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সংস্কারের জন্য। এ ছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন, প্রজাতন্ত্রের জনবল নিয়োগের জন্য সরকারি কর্ম কমিশন (সাধারণ), সরকারি কর্ম কমিশন (শিক্ষা) এবং সরকারি কর্ম কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
যেসব প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট
জুলাই সনদে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের মধ্যে ১০টি নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রের মূলনীতির প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও গণফোরামের। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্বের কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট ও এলডিপির। প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধানে ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গঠনপ্রক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত একমত হলেও পরের ধাপ নিয়ে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের ভিন্নমত আছে। অন্যদিকে একটি অংশে ভিন্নমত আছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। কোন ধরনের দল (নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত) উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করবে, তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। উচ্চকক্ষে পিআর ও প্রার্থী তালিকা প্রকাশ নিয়ে ভিন্নতম রয়েছে বিএনপি ও এনডিএমের। উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা নিয়ে ভিন্নমত সিপিবি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও আমজনতার দলের। নারী আসনের বিধানে সিপিবি, বাসদ, আমজনতার দলের ভিন্নমত রয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে (ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক) বিএনপিসহ সাতটি দল ও জোটের ভিন্নমত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে বিএনপিসহ সাতটি দল ও জোটের ভিন্নমত রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের একটি ধারা (নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত) সংশোধনে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভিন্নমত রয়েছে।
জুলাই সনদের শেষ অংশে আছে সনদ বাস্তবায়নে সাত দফা অঙ্গীকারনামা। এই সাত বিষয়ে অঙ্গীকার করে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে।