
মধ্যরাতে জরুরি ওষুধ কেনার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন শিক্ষার্থী আবাবিল আদিত্য আল ইসলাম (২২)। শনির আখড়া আন্ডারপাস পার হওয়ার সময় পড়লেন দুই ছিনতাইকারীর খপ্পরে। তারা দুটি দামি মোবাইল ফোনসহ টাকা ছিনিয়ে নেয় তাঁর কাছ থেকে। ছুরিকাঘাতে আহত হন তিনি। গত সোমবার দিবাগত রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে এই ঘটনা ঘটে।
এর আগে গত রবিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অটোরিকশা চোর ধরতে গিয়ে ব্রাহ্মন্দী ইউনিয়নের মারুয়াদী চৌরাস্তা এলাকায় ছুরিকাঘাতে ইমন মিয়া (২২) নামের এক যুবক নিহত হন।
শুধু রাজধানী ও আশপাশের জেলায় নয়, সারা দেশেই সম্প্রতি এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে গেছে। ছিনতাইকারীর ধারালো চাকু-ছুরি ও ব্লেডের আঘাতে হতাহত হচ্ছে পথচারী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকে ভোররাত পর্যন্ত ফুটপাত, নির্জন গলি, বাসস্ট্যান্ড, ফুট ওভারব্রিজ ও পার্কসংলগ্ন এলাকায় চলে তথাকথিত ‘চাকু ও ব্লেড পার্টি’র তৎপরতা। পথচারীদের ব্যাগ, পকেট বা পোশাক কেটে মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। ছুরি-চাকু দিয়ে ভয় দেখিয়ে মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ, দামি মোবাইল ফোন সেট, স্বর্ণালংকার ও টাকা ছিনিয়ে নিচ্ছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ফার্মগেট, নিউমার্কেট ও গুলিস্তানের এলাকার ব্যস্ত সড়ক ও ফুটপাতগুলোতে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর এমন ঘটনা ঘটার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
কয়েকজন ভুক্তভোগীর ভাষ্য, বেশির ভাগ সময় দু-তিনজনের দল মোটরসাইকেলে এসে বা হঠাৎ কোনো গলি থেকে বেরিয়ে চাকু, ব্লেড বা ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মোবাইল ফোন, টাকা ও মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিচ্ছে। সামান্য প্রতিবাদ করলেই তারা হামলা চালায়। এতে গুরুতর আহত হতে হয়, এমনকি ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যুও ঘটছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে সারা দেশে ছিনতাইয়ের ঘটনায় এক হাজার ৪৮৩টি মামলা করা হয়েছে। অথচ ২০২৪ সালে সারা বছরে একই ঘটনায় মামলা করা হয়েছে এক হাজার ৪১২টি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছিনতাই প্রতিরোধে কেবল পুলিশের অভিযান নয়, রাস্তার বাতি, সিসিটিভি ক্যামেরা ও স্থানীয় নজরদারি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা ও নির্জন স্থানে রাতে পুলিশের টহল বাড়াতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ সারা দেশে টহল ও নজরদারি চলমান রয়েছে। অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোতে সাদা পোশাকে পুলিশ ও গোয়েন্দাদল কাজ করছে।
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা : গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর চকবাজারে ছুরিকাঘাতে আহত আমিরলাল সরদার (৩৫) নামের এক যুবক মারা গেছেন। ২ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রামের পটিয়ায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মো. সদিয়া (৩৫) নামের এক রিকশাচালক খুন হয়েছেন। গত ২৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার শনির আখড়া এলাকায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে শান্ত আহমেদ বাবু (৩০) নামের এক যুবক নিহত হন। একই দিন ঢাকার সাভারের বিশমাইল এলাকায় ছিনতাইকারীর চাকুর আঘাতে একটি বেসরকারি কম্পানির কাভার্ড ভ্যানের চালক মো. শামীম হোসেন (৩০) নিহত হন। ৭ আগস্ট মধ্যরাতে সিলেট মহানগরে কোতোয়ালি মডেল থানার কয়েক শ গজ দূরে কিন ব্রিজ এলাকায় মো. ডালিম (৩৫) নামের এক যুবক ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক অস্থিরতা, কর্মহীন থাকা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ দৈনন্দিন জীবনের নানা সমস্যার কারণে এসব অপরাধমূলক ঘটনা বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধ দমনে অপরাধীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। সঠিক কর্মসংস্থান, কাউন্সেলিংসহ ইতিবাচক বিভিন্ন পদক্ষেপ এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনতে পারে।
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশ এখনো আগের মতো সক্রিয় হতে পারেনি। এটার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। কোন কোন এলাকায় চুরি-ছিনতাই বেশি, এ ব্যাপারে পুলিশকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তা পর্যালোচনা করে ধারাবাহিক অভিযান চালাতে হবে। একই সঙ্গে পুলিশি টহল আরো জোরদার করতে হবে।