Image description
খুমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগ, কমিশন না দিলে রোগী পাই না, তাই অনেকে বিকল্প উপায় খুঁজছে-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ম্যানেজার * গত কয়েক বছরে কমিশন বাণিজ্যে দিশেহারা হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে একাধিক প্রতিষ্ঠান

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (খুমেক) বহির্বিভাগে চলছে ভয়াবহ কমিশন বাণিজ্য। রোগীদের দেওয়া টেস্টের অর্থের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ কমিশন যাচ্ছে চিকিৎসকদের পকেটে। কমিশনের এই উচ্চহার পরিশোধে কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিনা টেস্টেই রিপোর্ট প্রদান করছেন। এতে একদিকে যেমন রোগীরা প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি সঠিক রোগ নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপত্র থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। চিকিৎসাব্যবস্থার নৈতিকতাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী সেজে যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে।

এতে আরও দেখা যায়, খুমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এক ধরনের গোলক ধাঁধায় পড়তে হয়। চিকিৎসক, বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও দালালদের একটি চক্রের মধ্যে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলেন তারা। দিনশেষে পকেট ফাঁকা হলেও রোগের সঠিক তথ্য নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।

হাসপাতালের সামনে উদয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৫ আগস্ট টেস্ট করাতে আসেন শাহনাজ পারভিন নামে এক নারী। এর আগে তিনি বহির্বিভাগের (অর্থো) চিকিৎসক এমএম রফিকুজ্জামানকে দেখান। চিকিৎসক তাকে সিবিসি, আরবিএস ও এক্সরে করতে পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের রুম থেকে বের হওয়ার পরপরই এক দালাল তাকে কৌশলে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে তিনটি পরীক্ষা বাবদ তার কাছ থেকে মাত্র এক হাজার টাকা নেওয়া হয়। অথচ এর স্বাভাবিক মূল্য প্রায় দেড় হাজার টাকা।

চর্ম ও যৌন চিকিৎসক ডা. মো. ইশতিয়াক মাহমুদকে দেখিয়েছেন মামুন (ছদ্মনাম)। তিনি সিবিসি, আরবিএস ও টিএসএইচ পরামর্শ দেন। যার বেসরকারি মূল্য ১৪শ’ টাকা। কিন্তু একই ডায়াগনস্টিক তার কাছ থেকে নিয়েছে মাত্র এক হাজার টাকা।

খুলনা হেলথ গার্ডেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ৭ আগস্ট সাদিয়া নামে এক রোগী যান। খুমেকের মেডিকেল অফিসার ডা. ওয়াহিদা সুলতানার দেওয়া সিবিসি ও ইউরিনারি টেস্ট করান তিনি। প্রতিষ্ঠানটি তার কাছ থেকে মাত্র ১৫০ টাকা রেখেছে। যার বেসরকারি রেট কমপক্ষে ৭৫০ টাকা।

উদয়ন ও খুলনা হেলথ গার্ডেনের মতো আরও ২৬টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে, যেগুলো হাসপাতালের রোগীদের টার্গেট করেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এভাবে কম টাকায় টেস্ট করানোর প্রতিযোগিতা চলে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার রোগী পাওয়ার বিনিময়ে টেস্টের ৫০% কমিশন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে এবং ১০% তার এটেন্ডেন্টসকে দেয়। কিন্তু এত বেশি কমিশন দেওয়ার পরও এত কম টাকায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো টেস্ট করছে কিভাবে। মূলত অনেক ক্ষেত্রে টেস্ট না করেই রোগীকে বানোয়াট রিপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই জালিয়াতির বিষয়টি চিকিৎসকদেরও অজানা নয়। তারা জেনে বুঝেই উচ্চহারে কমিশনের জন্য ওইসব প্রতিষ্ঠানে রোগী পাঠান।

এ বিষয়ে উদয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ম্যানেজার শেখ মাসুম যুগান্তরকে বলেন, যদি আউটডোরের চিকিৎসকদের কমিশন না দেই তাহলে রোগী পাব না। এখানকার ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো খুমেকের রোগীর ওপর নির্ভরশীল। চিকিৎসকদের সঙ্গে কমিশন নিয়ে ঝামেলা করলে ব্যবসা করতে পারব না। শুধু কমিশন নয়, বিভিন্ন সময়ে নাস্তা, ফল-ফলাদি দিয়েও তাদের মন রক্ষা করা যায় না।

খুলনা হেলথ গার্ডেনের ম্যানেজার মো. রিয়াছাদ বলেন, আগে ২৫-৩০ শতাংশ কমিশন নিতেন চিকিৎসকরা। এখন ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রেট বেড়েছে। যারা যত কমিশন দেবে চিকিৎসকরা তত রোগী পাঠাবেন। কমিশন দিতে না পেরে অনেকেই বিকল্প উপায় খুঁজছেন।

এ বিষয়ে বহির্বিভাগের (আবাসিক মেডিকেল অফিসার) ডা. শামীম হোসেন বলেন, বহির্বিভাগে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ রোগী আসে। আমরা তাদের মেডিকেলের ভেতর থেকে পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেই। কোনো চিকিৎসক বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন নেয় এমন আভিযোগ আমাদের কাছে নেই। থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করব।

তবে বিষয়টি স্বীকার করে চিকিৎসকের একাধিক এটেন্ডেন্টস (আউটসোর্সিং কর্মচারী) নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তারা নিয়মিত বেতন পান না। এজন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ১০ শতাংশ টাকা আদায় করে থাকেন।

উচ্চ কমিশনের চাপে বন্ধ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান : কমিশন বাণিজ্যে দিশেহারা হয়ে গত কয়েক বছরে বন্ধ হয়ে গেছে একাধিক প্রতিষ্ঠান। খুমেক হাসপাতালের সামনেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হতো। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে-লাইফ লাইন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফাস্ট কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও সিটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এছাড়া ব্যবসা ছেড়েছেন হিউম্যান কেয়ার ও ম্যাক্স কেয়ারের মালিক।

বন্ধ হয়ে যাওয়া ফাস্ট কেয়ারের মালিক আবু শাহাদাৎ হোসেন বলেন, একটি রোগী এলে ৫০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে। আরও ১০ শতাংশ দিতে হতো তার এটেন্ডেন্টকে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় তাদের উপঢৌকন দিতে হয়। বাকি ৪০ শতাংশে প্রতিষ্ঠান মালিকের সব খরচ তুলতে হয়। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে ডায়াগনসিস করে তবে এত কমিশন দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অসুখ নিয়ে রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করতে পারব না বলেই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছি।

বন্ধ হয়ে যাওয়া লাইফ লাইন ডায়াগনস্টিকের মালিক মো. হেলাল বলেন, চিকিৎসকদের দিনের কমিশন দিনেই দিতে হয়। না দিলে পরদিন আর রোগী পাই না। এত উচ্চ কমিশন দিতে না পেরে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছি।

এদিকে সম্প্রতি খুমেক হাসপাতালের নানা অনিয়মের বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানে গেলে বাদ সাধে কর্তৃপক্ষ। তারা বিষয়টিকে নেতিবাচক হিসাবে দেখে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ৯ অক্টোবর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন হাসপাতালের পরিচালক। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, কোনো সাংবাদিক হাসপাতালে অবস্থিত রোগীর সাক্ষাৎকার, ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে পরিচালকের লিখিত অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায় তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এসব বিষয় নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে রোববার তাকে পাওয়া যায়নি। হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া ঠিক হয়নি। এটা আমরা সংশোধন করছি। বহির্বিভাগের কমিশন বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি কখনো। কয়েকটা স্লিপ দেখালে তিনি বলেন, অজ্ঞাতসারে কেউ কেউ এ ধরনের কাজ করতে পারে সেটা আমাদের জানা নেই। আমরা এ বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।