
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট (রেফারেন্ডাম) একই দিনে আয়োজন করতে হলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুতি নিতে অন্তত দেড় মাস সময়ের প্রয়োজন হবে। ওই সময়ের মধ্যে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ১৫ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ঢাকনাসহ নির্বাচনি সামগ্রী কেনার প্রয়োজন হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে আনুমানিক ৫০ হাজার ভোটকক্ষ বাড়াতে হবে। এজন্য নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যা অন্তত দেড় লাখ বেড়ে যাবে। পক্ষান্তরে ভিন্ন দিনে জাতীয় সংসদ ও গণভোট হলে নির্বাচনি ওইসব সামগ্রী কেনার প্রয়োজন হবে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ এবং অন্যান্য প্রস্তুতি দিয়ে গণভোট আয়োজন করা সম্ভব হবে। একাধিক দিনে ভোট হলে ব্যালট পেপার ছাপাতে সময় লাগবে ১৫ দিন। আর একই দিনে হলে ওই নির্বাচনের ব্যালট ছাপতে লাগবে এক মাস। তবে একই দিনে দুটি ভোটের আয়োজন করলে নির্বাচনি ব্যয় অনেক কম হবে। একাধিক দিনে এ দুটি ভোটের আয়োজন করলে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। সম্ভাব্য প্রস্তুতির বিষয়ে ইসির কর্মকর্তাদের এক পর্যালোচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, গণভোট আয়োজনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একটি কর্মপরিকল্পনা বা রোডম্যাপ তৈরির বিষয় নিয়ে এগোচ্ছেন ইসির কর্মকর্তারা। সেখানে কোন কাজ কখন শেষ করা হবে তার সময়সীমা উল্লেখ থাকবে। তবে গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়ার আগে আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরুর বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ইসি। এমনকি গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য চলাবস্থায় নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বিতর্কে জড়াতে চায় না। এ জন্য এ বিষয়ে কথা বলতেও রাজি হচ্ছেন না ইসির দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা। এমনকি ইসির প্রস্তুতিমূলক কাজ সংক্রান্ত নথিও তৈরি করা হয়নি। গণভোটের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ রোববার যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। সরকারের সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আমাদের অবস্থান জানাতে পারব।
প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কাজের তালিকায় যেহেতু এখনও গণভোট যুক্ত হয়নি, তাই এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটে একমত হয়েছে। তবে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একদিনে নাকি একাধিক দিনে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। আর ভোটগ্রহণ হবে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে। এ লক্ষ্যে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো শেষ করার টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করতে হলে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসিকে জানাতে হবে। অন্যথায় প্রস্তুতির ঘাটতি থেকে যাবে। তারা আরও জানান, সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে বা একাধিক দিনে আয়োজন করতে হলে কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে-তা পর্যালোচনা শুরু করেছেন।
জানা গেছে, ইসির কর্মকর্তাদের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গণভোটের জন্য কিছু নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি দিয়েও কিছু কিছু বিষয় পূরণ করা সম্ভব হবে। আরও দেখা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একইসঙ্গে অনুষ্ঠিত হলে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ স্থাপন ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসবে। এতে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ বাড়বে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তিনটি ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ করা হয়, তাই সেখানে প্রতি ৪০০ জন পুরুষ এবং প্রতি ৩৫০ জন নারী ভোটারের জন্য একটি করে ভোটকক্ষ নির্ধারণ করা হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করা হলে ওই হারে ভোটকক্ষ নির্ধারণের প্রয়োজন হবে। সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র বহাল রাখা হলেও আনুমানিক ৫০ হাজার ভোটকক্ষ বাড়বে। বাড়তি ভোটকক্ষের জন্য ১৫ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ঢাকনা কিনতে হবে। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এসব সামগ্রী কিনতে দেড় মাস সময় লাগবে।
অপরদিকে পৃথক দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজন করা হলে নতুন ব্যালট বাক্স ও ঢাকনা কেনার প্রয়োজন হবে না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র ব্যবহার করে গণভোট নেওয়া সম্ভব। প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খসড়া তালিকায় ৪২ হাজার ৬১৮টি ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ ৪৪ হাজার ৪৬টি ভোটকক্ষ রয়েছে। প্রতি ৫০০ জন নারী ও ৬০০ জন পুরুষের জন্য একটি কক্ষ নির্ধারণ করায় এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে।
ইসির পর্যালোচনায় আরও উঠে এসেছে, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচনি সামগ্রী যথা-ব্যালট বাক্সের লক, অফিশিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাস সিল, স্ট্যাম্প প্যাড, অমোচনীয় কালি, গানি ব্যাগ, হেসিয়ান ব্যাগ সংগ্রহ করছে ইসি। চলতি মাসের মধ্যে এসব সামগ্রী ইসির কাছে সরবরাহ করার কথা রয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য কেনা সামগ্রী দিয়েই গণভোটের নির্বাচন করা যাবে। আলাদা করে সামগ্রী কেনার দরকার হবে না।
তবে গণভোটের জন্য ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা, নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকার ম্যানুয়েল, বিভিন্ন ধরনের ফরম, প্যাকেট, পরিচয়পত্র, পোস্টার ইত্যাদি ছাপাতে হবে। তফশিল ঘোষণার এক থেকে দেড় মাস আগে এই কাজ শেষ করতে হবে। সরকারি প্রিন্টিং প্রেস থেকে এসব ছাপাতে ১৫-২০ দিন সময়ের প্রয়োজন হবে। একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হলে ব্যালট পেপার ছাপার সময় বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে এক মাস সময় লাগবে। আর ভিন্ন দিনে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট হলে তা ছাপতে লাগবে ১৫ দিন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য ব্যয় এখনও চূড়ান্ত করেনি ইসি। এ কারণে গণভোটের ব্যয় নির্ধারণ করা যায়নি। তবে ইসির কর্মকর্তারা জানান, একইদিনে দুটি নির্বাচন হলে বাড়তি ৫০ হাজার ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার পেছনে ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এছাড়া মুদ্রণসহ অন্যান্য খাতে আরও কিছু ব্যয় হবে। আর ভিন্ন তারিখে নির্বাচন হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাছাকাছি ব্যয় হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একই দিনে জাতীয় সংসদ ও গণভোট অনুষ্ঠিত হলে এক ব্যবস্থাপনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পরিকল্পনা ও আন্তঃমন্ত্রণালয় ব্যবস্থাপনা করা হবে। আর পৃথক দিনে ভোট হলে তা ভিন্ন ভিন্ন হবে। ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।