Image description
জুলাই সনদ নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতভিন্নতা কাটছে না * গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইস্যুতে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে

জাতীয় নির্বাচনের বাকি আর মাত্র চার মাস। বিভিন্ন দলের মধ্যে নানা ইস্যুতে মতপার্থক্যের মধ্যেই দেশজুড়ে বইছে নির্বাচনি উত্তাপ। তবে জুলাই সনদ নিয়ে কোলাহলের আবর্তে দেশের রাজনীতি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিপরীতমুখী বক্তব্য নির্বাচন নিয়ে কখনো কখনো জনমনে তৈরি হচ্ছে সন্দেহ ও অবিশ্বাস। ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার’-সংস্কার এবং নির্বাচন প্রশ্নে বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ যেন বাস্তবে ধরা দিয়েছে দেশের রাজনীতিতে। বিশেষ করে গণভোট ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) নিয়ে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একপক্ষ চান একই দিনে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন। আরেকপক্ষ চাচ্ছে গণভোট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে। গণভোটের ভিত্তিতেই হবে জাতীয় নির্বাচন। এই মতপার্থক্য ঘোচাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে নির্বাচনি প্রতীক বরাদ্দ নিয়েও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং নির্বাচন কমিশন রীতিমতো মুখোমুখি অবস্থানে। এ নিয়ে প্রতিদিন দুইপক্ষের অনড় অবস্থানের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসায় নির্বাচন নিয়ে সন্দেহের পালে হাওয়া লাগছে। ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। রাজনীতিবিদসহ বিশ্লেষকদের প্রশ্ন-সব মত এবং পথের বৃহত্তম ঐক্যের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষের যে বিজয় অর্জিত হয়েছে, তা এক বছরের মাথায় এই অনৈক্য এবং মুখোমুখি অবস্থান সর্বনাশ ডেকে আনছে না তো?

দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্রমঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনাজোটসহ কিছু রাজনৈতিক দল চাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে হোক। আর জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে অনড়। গণভোটের প্রশ্ন কী হবে, ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে হবে-এসব প্রশ্নেও রয়েছে মতভিন্নতা। এনসিপি পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের নিশ্চয়তা চায়। উচ্চকক্ষের পাশাপাশি নিুকক্ষেও পিআর চায় জামায়াত। অন্যদিকে পিআর নিয়ে সম্মত নয় বিএনপি। দলটি মনে করে, উচ্চকক্ষে পিআরের দাবি মানলে নিুকক্ষের জন্যও একই দাবি তোলা হবে। জামায়াত মনে করছে, একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে যে উদ্দেশ্যে গণভোট, তা জাতীয় নির্বাচনের কোলাহলে গুরুত্ব হারাবে। অন্যদিকে বিএনপির শঙ্কা, আগে গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিলে জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি বিলম্বিত করার অজুহাত তৈরি হতে পারে।

এদিকে শাপলা প্রতীকের দাবিতে অনড় অবস্থানে এনসিপি। নির্বাচন কমিশনও এই প্রতীক না দেওয়ার বিষয়ে তাদের অবস্থানে অটল। এ নিয়ে দুইপক্ষের মধ্যে চলছে বাহাস। এদিকে পিআর নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠনে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় শরিক দল এবং এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ এবং এবি পার্টি। এই ৯টি দল এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছে। বুধবার তারা জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করে। এর আগে কথা বলেছে বিএনপির সঙ্গেও। জানা যায়, বিএনপি যদি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নেয় তবে জামায়াতও নিুকক্ষে পিআরসহ অন্যান্য দাবি থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে নমনীয় হবে। বিষয়টি এখন আর আলোচনার টেবিলে সীমাবদ্ধ নেই। বল রাজপথেও গড়িয়েছে। জামায়াত ইসলামীসহ কয়েকটি সমমনা রাজনৈতিক দল তাদের দাবি বাস্তবায়নে রাজপথে রয়েছে। বিএনপি রাজপথে না থাকলেও দলের ঘরোয়া কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে তাদের অবস্থানের কথা তুলে ধরছেন।

রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) আয়োজিত এক স্মরণসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, পিআর পদ্ধতি এদেশের মানুষ বোঝে না। একটি রাজনৈতিক দল এ নিয়ে আন্দোলন করছে। এর মূল লক্ষ্য হলো, নির্বাচন বিলম্বিত করা। চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছুই এদেশের মানুষ মেনে নেবে না।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার রোববার যুগান্তরকে বলেন, পিআর ছাড়া জনগণ কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না। আসন্ন নির্বাচন শুধু নির্বাচন নয়; এটি একটি বিপ্লব-পরবর্তী জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের সুযোগ।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না রোববার যুগান্তরকে বলেন, অনেক রক্তের বিনিময়ে, অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। যারা একসঙ্গে, এককাতারে মিলে মিলে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করেছে, তাদের মধ্যে বিভক্তি, অনৈক্য রাজনীতিতে সংকট বাড়াবে। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে সবাইকে নির্বাচনমুখী হতে হবে। মানুষ ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে। তারা আর বিবাদ-বিতণ্ডা দেখতে চায় না।

এবি পার্টি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে দীর্ঘ সংলাপের পর জুলাই সনদ নামে যে দলিল চূড়ান্ত হয়েছে তা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিস্মরণীয় অর্জন। সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এই দ্বিমত বা মতদ্বৈততা থেকে যদি নতুন কোনো জটিলতা তৈরি হয়, তাহলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। তরুণ প্রজন্ম ও ভোটাররা এটা মনে রাখবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার এই মতবিরোধ এবং বিপরীতমুখী অবস্থান বাংলাদেশের রাজনীতিকে আবারও এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ সেই নির্বাচনকে ক্রমশ অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ফ্রেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও (ইসি) বসে নেই। এ লক্ষ্যে তারা যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এক্ষেত্রে আরও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।

চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তিন দফায় ৭২টি বৈঠকের পর ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে কমিশন। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘জুলাই সনদ’। এই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের দিনক্ষণ, পিআর পদ্ধতি, সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য আছে। এ অবস্থার মধ্যেই আগামী ১৭ অক্টোবর শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। এর আগে ১৫ অক্টোবর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার চেষ্টার অংশ হিসাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের তারিখ দুদিন পেছানো হয়েছে।