
নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে যুগ যুগ ধরে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে স্বর্ণ। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতো বাংলাদেশেও উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত সবার সঞ্চয় ও আর্থিক নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের খনিজ এ ধাতুটি। যখনই বৈশ্বিক কোনো সংকট দেখা দেয় বা অনিশ্চয়তা বাড়ে, তখনই আলাদা করে বাড়ে স্বর্ণের কদরও। বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দাম বাড়ে বাংলাদেশেও। বর্তমানে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করছে স্বর্ণের দর। এর আগে স্বর্ণের দাম কখনোই এতটা বাড়েনি। শুধু দেশের ইতিহাসেই সর্বোচ্চ নয়, বর্তমান আন্তর্জাতিক দরকেও ছাড়িয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশগুলোর তুলনায়ও স্বর্ণের এ দর অনেক বেশি। দেশের স্বর্ণবাজারে রেকর্ড এই ঊর্ধ্বগতির নেপথ্যে শুধু বৈশ্বিক প্রভাবক নয়, কাজ করছে স্থানীয় একাধিক অদৃশ্য চালিকাশক্তিও।
আন্তর্জাতিক বাজারদর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, কাতার, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের তুলনায় স্বর্ণের দাম কম। আর এই রেকর্ড দাম বাড়ার প্রভাবে কমে গেছে স্বর্ণের অলংকার বিক্রিও। ফলে বিপাকে রয়েছেন এই খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও।
অলংকার হিসেবে ব্যবহার বা উপহার দেওয়ায় দেশে স্বর্ণের বিপুল পরিমাণ হাতবদল হয়। যদিও কয়েক বছর ধরে স্বর্ণের দাম যে হারে বেড়েছে, এতে করে বিপাকে পড়েন স্বর্ণের গহনা ব্যবহারকারী ক্রেতারা। আবার দাম বাড়ার ফলে গহনা বিক্রিও কমে গেছে বলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বিশ্লেষক এবং এ খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে চীন ও রাশিয়ার। সবাই যার যার মুদ্রাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ স্বর্ণ মজুত আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। পাশাপাশি চীন ও রাশিয়াও বাড়াচ্ছে স্বর্ণের মজুত। আর এতে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের চাহিদা বাড়ায় দামও বাড়ছে হুহু করে। যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমানো হবে—এমন ধারণায়ও বিনিয়োগকারীদের অনেকে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও রিজার্ভের অংশ হিসেবে ধারাবাহিকভাবে স্বর্ণ কিনছে। এতে বৈশ্বিক বাজারে চাহিদা বেড়ে দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
দেশে স্বর্ণের দর মূলত নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। সংগঠনটি বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম ঠিক করে থাকে। তেজাবি (খাঁটি) স্বর্ণের দামের সঙ্গে মুনাফা যোগ করে জুয়েলারির (অলংকার তৈরি সংশ্লিষ্ট) স্বর্ণের দর নির্ধারণ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই পদ্ধতিতে স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করছে বাজুস। এতে দেখা যায়, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে কয়েকদিন পরপরই স্বর্ণের নতুন দামের তথ্য দিয়ে থাকে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনটি। তবে বাংলাদেশে স্বর্ণের যে দাম, তা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। বেশিরভাগ দেশেই বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম দামে স্বর্ণ বেচাকেনা হয়।
কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বর্তমানে ইতিহাসের সর্বোচ্চ। বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখেই দেশে স্বর্ণের দাম ঠিক করা হয়। এই দরের সঙ্গে আবার যুক্ত হয় মজুরি, দোকান পরিচালন খরচ ইত্যাদি। এসব যোগ হয়ে দেখা যায়, বিশ্ববাজারের চেয়ে বাংলাদেশে দাম বেড়ে যায়।
বাজুসের ভাষ্য, স্বর্ণের দাম নির্ধারণ হয় বিশ্ববাজারের দামের ভিত্তিতে এবং দেশের তাঁতীবাজার বুলিয়ান মার্কেটের নির্ধারিত দামে। বাজুস শুধু তার ভিত্তিতে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। বিক্রয় মূল্যের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে সরকার আরোপিত ৫ শতাংশ ভ্যাট ও বাজুস নির্ধারিত ৬ শতাংশ মজুরি যোগ করার পর চূড়ান্ত দর নির্ধারণ হয়। আর এতে করে বিশ্ববাজারের সঙ্গে দামের তারতম্য হয়।
বুলিয়ান মার্কেটের পরিস্থিতি: দেশে স্বর্ণ কেনাবেচার সবচেয়ে বড় মার্কেট রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার। গতকাল বুধবার এই মার্কেট ঘুরে সেখানকার বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই বাজারে স্বর্ণের বেচাবিক্রি অর্ধেকে নেমেছে। অস্বাভাবিক হারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। কমে গেছে স্বর্ণ ক্রেতাদের আনাগোনাও।
বাজারটির আপন বুলিয়ানের শুভ সাহা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বিশ্ববাজারের সঙ্গে আপডেট (হালনাগাদ তথ্য অবগত) থাকি। বিশ্ববাজারে দাম ওঠানামার সঙ্গে আমাদেরও দাম ওঠানামা করে। তবে এখানে বিশ্ববাজারের চেয়ে দাম বেশি হওয়ার বেশ কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে দোকান খরচ, কর্মচারী খরচ, তারপর স্বর্ণকে জুয়েলারিতে (অলংকার) রূপান্তর করার ফলে স্বর্ণের ঘাটতি হওয়ায় দিন শেষে সবকিছু যোগ করে দাম নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম মেলে না।’
দাম বাড়ায় বেচাবিক্রি কমার তথ্য জানান মার্কেটটির অমিয় গোল্ড মিউজিয়ামের স্বত্বাধিকারী সুমন দাস। তিনি বলেন, ‘স্বর্ণের দাম হঠাৎ করে যে বাড়া বেড়েছে তাতে আমাদের বিক্রি একেবারেই কমে গেছে। অর্ধেক হয়ে গেছে বিক্রি। দাম বেশি থাকার কারণে ক্রেতারাও আসেন না তেমন।’
একতা জুয়েলার্সের জয়ন্ত দাস বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রতি আউন্সের দাম ৪ হাজার ডলারে উঠে গেছে। আমাদের বাজারে ২৪ ক্যারেটের খাঁটি স্বর্ণের বার ও টুকরা থেকে জুয়েলারিতে রূপান্তর করতে হয়। ফলে এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে দাম বেড়ে যায়। তবে আমাদের বিক্রি একদম শেষ হয়ে গেছে (বিক্রি নেমেছে তলানিতে)।’
বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশে দাম বেশি: বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বর্ণের বাজারগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, শুধু বাংলাদেশের বাজারেই স্বর্ণের দাম সবচেয়ে বেশি। গতকাল দেশের বাজারে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের প্রতি ভরি (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) দাম বেড়ে ২ লাখ ৯ হাজার ১০০ টাকায় ওঠে। রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেখা গেছে, স্পট মার্কেটে ২৪ ক্যারেটের প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) স্বর্ণের দাম ৪ হাজার ৪৫ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করছে। এদিন যুক্তরাষ্ট্রে ২২ ক্যারেট প্রতি ভরির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৯০ টাকা ছিল। আর স্পট মার্কেটে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩ হাজার ৬৪২ ডলারের মধ্যে ওঠানামা করেছে।
পাশের দেশ ভারতে ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এ ছাড়া পাকিস্তানে প্রতি ভরির দাম ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা, কাতারে প্রতি ভরি ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫০ টাকা, মালয়েশিয়ায় তা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৬০ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৭০০ এবং সৌদি আরবে প্রতি ভরি ১ লাখ ৬৫ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাজুসের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সংগঠনটির প্রাইস অ্যান্ড প্রাইস মনিটরিং কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা তাঁতীবাজারের বুলিয়ান মার্কেট থেকে যে দর পাই তার ভিত্তিতেই স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করি। প্রতিদিন বুলিয়ান মার্কেট থেকে বাজুস দর সংগ্রহ করে। আমরা যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকগুলো দ্বারা একটা দাম পেতাম তাহলে সরকার নির্ধারিত দাম দেওয়া যেত। কিন্তু এই সুযোগটা নেই বাংলাদেশে।’
দেশে এক বছরে দাম বেড়েছে ৮৫ শতাংশ: দেশে গত বছরের ২৭ এপ্রিল ২২ ক্যারেট প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা। গত এক বছরে বেশ কয়েকবার উত্থান-পতন হয়েছে দামের। তবে যতবার দাম কমেছে, অর্থাৎ যে পরিমাণ কমেছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে। দেখা গেছে, দুই দফায় ৫ হাজার টাকা বাড়ার পর কমেছে এক বা দেড় হাজার টাকা। এভাবে গত এক বছরে দাম বেড়ে এখন ২ লাখ ৯ হাজার ১০০ টাকায় উঠেছে। এ হিসাবে, এক বছরে প্রতি ভরিতে ৯৬ হাজার ১০০ টাকা বা ৮৫ শতাংশ দাম বেড়েছে।
অন্যান্য দেশের চিত্র: এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৮০ টাকা। এরপর কয়েকদিন দাম ওঠানামার মধ্যে দিয়ে গেলেও বছরের ব্যবধানে এই দাম ৪৫ হাজার ৪১০ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৯০ টাকায়।
এক বছর আগে ভারতের বাজারে গত বছরের ৮ অক্টোবর ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ২৮৪ টাকা। এরপর আর এ দাম কমেনি, বরং প্রতিদিন বেড়েছে। দাম বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৫৩ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ভারতে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৩ হাজার ৬৯ টাকা।
১৭০ টাকা ভরি থেকে ২ লাখ, বেড়েছে ১২৩০ গুণ: দেশে ৭০ দশকের সময় স্বর্ণের ভরি ছিল ১৭০ টাকা। তারপরের পাঁচ দশকে দাম বেড়েছে ১২৩০ গুণ। এখন এক ভরি স্বর্ণের দর ২ লাখ ৯ হাজার ১০০ টাকা। আর এই দাম বেশি বেড়েছে বিগত আড়াই দশকে। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের ভরি ছিল ৬ হাজার ৯০০ টাকা। পরের পাঁচ বছরে সেটি দ্বিগুণ হয়। ২০১০ সালে স্বর্ণের দাম তিন গুণ বেড়ে হয় ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা। ২০১৫ সাল পর্যন্ত দাম খুব একটা না বাড়লেও তার পরের পাঁচ বছরে ভরিপ্রতি ২৬ হাজার ৮৫২ টাকা বেড়ে যায়। ২০২০ সালে বেড়ে হয় ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকা।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল ২২ ক্যারেট প্রতি ভরির স্বর্ণের দাম ছিল প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা। গত এক বছরে বেশ কয়েকবার উত্থান-পতন হয়েছে দামের। তবে যতবার দাম কমেছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে। গত এক বছরে প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৯৬ হাজার ১০০ টাকা।
বাজুসের নির্বাহী সদস্য ও সিরাজ জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী দেওয়ান আমিনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘একজন সাধারণ ব্যবসায়ী হিসেবে আমি বলব, দাম বাড়ার ফলে ব্যবসার খুব খারাপ অবস্থা। বর্তমানে দামটা অতিরিক্ত বেড়েছে। এই দাম কবে কমবে, তা বলা মুশকিল। তবে যেহেতু মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে, সেহেতু আশা করা যায় দামটা আবারও কমবে। তবে সেটা কবে তা নিশ্চিত নয়।’
পুরোনো অলংকারে চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ: বাংলাদেশের স্বর্ণের বাজারটা আকারে খুব বড় নয়। দেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ টন স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। যার মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় পুরোনো অলংকার দিয়ে। বাকিটা ব্যাগেজ রুলের আওতায় ও অবৈধ পথে বিদেশ থেকে আসে।
জুয়েলার্স সমিতির একজন নেতা বলেন, ‘দেশে যেহেতু বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানি করা হয় না এবং আমাদের স্বর্ণ পরিশোধনের কোনো কারখানাও নেই, সেহেতু ব্যাগেজ বিধিমালায় অলংকার আনায় কড়াকড়ি আরোপটি ভালো সিদ্ধান্ত হয়নি। এতে অবৈধ পথে স্বর্ণ আসা বাড়বে। স্বর্ণ আমদানি সহজ না করে শুধু ব্যাগেজ বিধিমালায় স্বর্ণের বার ও অলংকার আনায় কড়াকড়ি আরোপ করায় সংকট আরও বাড়বে।’
উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে বাড়ে দাম: বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে স্বর্ণের দামের সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা মানে স্বর্ণের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি। কারণ, অস্থির সময়ে বিভিন্ন দেশ নিরাপদ বিবেচনায় স্বর্ণে বিনিয়োগ করে। ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে স্বর্ণের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৭০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। সেটিই ছিল ততদিন ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মাসের শুরুতে বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তখন স্বর্ণের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। স্পট মার্কেটে নতুন দর ওঠে আউন্সপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার ডলারে। মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগান আগামী বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল।
আমদানি প্রায় বন্ধ: দেশে বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানি হয় না বললেই চলে। স্বর্ণ আসে বিদেশফেরত যাত্রীদের হাতে হাতে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণ আনার সুযোগ ২৩৪ গ্রাম থেকে কমিয়ে ১১৭ গ্রাম করা হয়। পাশাপাশি ভরিপ্রতি শুল্ক দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হয়। ভরিপ্রতি চার হাজার টাকা শুল্ক ধরার পরও দেখা যায়, অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেশি। যদিও দেশে অবৈধ পথেই বেশিরভাগ স্বর্ণ আসে বলে সন্দেহ করা হয়। ফলে চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ হয় পুরোনো স্বর্ণ দিয়েই।
স্বর্ণের ব্যবসায় স্বচ্ছতা আনতে ২০১৮ সালে স্বর্ণ নীতিমালা করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালের নভেম্বরে একটি ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির লাইসেন্স দেয়। পরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায়। শুরুতে একাধিক প্রতিষ্ঠান কয়েকটি চালানে স্বর্ণ আমদানি করেছিল। পরে সেখানে ভাটা পড়ে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, অনুমতি পেতে সময়ক্ষেপণ ও শুল্কের কারণে আমদানিতে আগ্রহ হারান ব্যবসায়ীরা।
ইতিহাসের রেকর্ড দামে বিক্রিতে ভাটা: বাংলাদেশে বিয়েতে স্বর্ণের গয়না উপহার দেওয়ার রীতি রয়েছে। এ কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো বাধ্য হয়ে স্বর্ণ কিনে থাকে। আবার অনেকে স্বর্ণের গয়না পছন্দ করেন, শখের বসে কেনেন কেউ কেউ। তবে এখন স্বর্ণের গয়না নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। ফলে তারা চাইলেও স্বর্ণ কিনতে পারছেন না। কয়েকটি মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন চাইলেও বিয়েতে আর সেভাবে স্বর্ণ উপহার দিতে পারছেন না তারা।
স্বর্ণের অলংকার বিক্রেতারাও কথা বলেছেন একই সুরে। তারা জানান, সাধারণ ক্রেতারা স্বর্ণের গয়না কেনা কমিয়েছেন। আগে যেখানে সারা দিনে বহু ক্রেতা আসতেন এবং স্বর্ণ কিনতেন, সেখানে সারা দিনে এখন কোনো কোনো দিন একজন ক্রেতারও দেখা মিলছে না। সব মিলিয়ে বিক্রিতে ভাটা পড়েছে।
রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে রয়েছে ১১৫টি জুয়েলারি দোকান। সেখানকার শরীফ জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী আজিজুর রহমান বলেন, ‘দেশটাকে আগের রাঘববোয়ালরা শেষ করে দিয়েছে। শেয়ার মার্কেটের পাশাপাশি তারা দেশের স্বর্ণের বাজারকে একদম ধ্বংস করে ফেলেছে। দেশ থেকে সব বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। দেশে এজন্যই এখন হাহাকার লেগেছে। বিক্রি একবারেই নেই।’
মার্কেটটিতে স্বর্ণালংকার বিক্রি করতে আসা কল্পনা বেগম কালবেলাকে বলেন, ‘আমার স্বর্ণগুলো অনেক আগে কেনা ছিল। তখন অনেক কম দরেই কিনেছিলাম। কিন্তু এখন টাকার প্রয়োজন, আর দামও পাচ্ছি ভালো। তাই এগুলো বিক্রি করে দিচ্ছি।’
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য: বাজুসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংগঠনটির পক্ষ থেকে কালবেলাকে জানানো হয়, দেশে স্বর্ণ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বাজুসের তালিকাভুক্ত সদস্য রয়েছেন ২৩ হাজার। আর সারা দেশে এই জুয়েলারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ৪০ হাজার ব্যবসায়ী। এর মধ্যে ভেনাস জুয়েলার্স, আমিন জুয়েলার্স, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, আপন জুয়েলার্স, সুলতানা জুয়েলার্সের মতো বেশ কিছু ব্র্যান্ড থাকলেও বেশিরভাগই মাঝারি ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান।
স্বর্ণের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে বাজুস বলেছে, ভূরাজনৈতিক ও ট্যারিফ পলিসির অনিশ্চয়তা এবং বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণের মজুত বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সাধারণ ক্রেতারা স্বর্ণে বিনিয়োগ বাড়ানোর কারণে দাম বেড়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক কর্তৃক স্বর্ণকে নিরপেক্ষ ট্যারিফ প্রতিবন্ধক মজুত সম্পদ হিসেবে দেখা, বিশ্বের সব ব্যাংক ও সাধারণ ক্রেতারা স্বর্ণকে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা এবং শিল্প খাতেও স্বর্ণের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়া বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।
সংগঠনটি আরও বলেছে, দাম বাড়ার কারণে দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা হিমশিম খাচ্ছেন এবং ব্যবসায় প্রতিকূল অবস্থা পার করছেন। কিন্তু স্বর্ণের দাম নির্ধারণ হয় বিশ্ববাজারের দামের ভিত্তিতে এবং দেশের তাঁতীবাজার বুলিয়ান মার্কেটের নির্ধারিত দামে। বাজুস শুধু তার ভিত্তিতে বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। এক্ষেত্রে দাম কমাতে বাজুসের করণীয় বিশেষ কিছু নেই। যেহেতু বিশ্ববাজারের সংশ্লিষ্টতা এখানে আছে।
বাজুসের সাবেক সভাপতি ও বাজুস স্ট্যান্ডিং কমিটি অন ল অ্যান্ড মেম্বারশিপের চেয়ারম্যান এম এ ওয়াদুদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘এমন আকাশচুম্বী দাম বাড়া অবশ্যই জুয়েলারি শিল্পের জন্য হুমকি। যে হারে দাম বেড়েছে তা কোথায় গিয়ে এবং কবে থামবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ফলে বর্তমানে যে হারে দাম বাড়ছে তা এ শিল্পের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’