
রিট বা আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে ঋণখেলাপি থেকে পার পাওয়া কঠিন করা হচ্ছে। চাইলেই আর সহজে রিট করা যাবে না। এ জন্য বাড়তি খরচ করতে হবে। এ খরচের অঙ্ক ৬ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক বিশেষ বৈঠকে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকরা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান আর্থিক কর্মকর্তারা (সিএফও)।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ঋণ পরিশোধ না করেও আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য আইনের অপব্যবহার ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছে সরকার।
ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ঋণ ছয় মাস পরিশোধ না হলে তা খেলাপি হিসেবে গণ্য হয়। খেলাপি হলে নতুন ঋণ নেওয়া, আমদানি-রপ্তানির জন্য এলসি খোলা বা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না। কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে এসব ঋণগ্রহীতাকে সিআইবির তালিকায় খেলাপি দেখানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে মোট মামলা হয়েছে দুই লাখ ৫৩ হাজার ৯১টি। এসব মামলার বিপরীতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৩ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিচারাধীন মামলাতেই আটকে আছে প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। অথচ এত বিপুল টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ছয় হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা, যা মোট পাওনার মাত্র ৩ শতাংশ।
অন্যদিকে আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে এক হাজার ৮৬ জন ঋণগ্রহীতার এক লাখ ৬৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। প্রতি জনের গড় ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ থেকে ১০ বছরে ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। অনেক কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর দায়মুক্তি পাচ্ছেন। তাই সরকার এমন নীতিমালা তৈরি করতে চায়, যাতে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত উভয় অবস্থায়ই অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তারা শাস্তি পান। এমনকি তাদের সার্ভিস বেনিফিট বাতিলের বিধানও বিবেচনায় আছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত এক ব্যাংকের এমডি বলেন, ‘অনেক কর্মকর্তা ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত হয়ে অবসরের অপেক্ষায় থাকেন। ভবিষ্যতে যেন কেউ এভাবে পার পেয়ে না যান, সে জন্য আইন পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে বিভিন্ন অভিযোগে জব্দ (ফ্রিজ) হওয়া ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা চলছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক এসংক্রান্ত সুপারিশ করেছে। বর্তমানে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করছে, যা ভবিষ্যতে আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উচ্চ সুদনির্ভর আমানত কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘একজন চেয়ারম্যান বা বোর্ড সদস্য একা লুটপাট করতে পারে না। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তাদেরও জড়িত থাকতে হয়। যেমন—জনতা ব্যাংকের ক্ষেত্রে শুধু আবুল বারকাত নন, যাঁরা তাঁকে সহযোগিতা করেছেন তাঁদেরও দায়ী করতে হবে।’
সভায় রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের সুশাসন নিশ্চিত করা, ঋণ জালিয়াতি রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভবিষ্যতে অনিয়ম ঠেকাতে আইনি সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকার চায়, ব্যাংক খাতে এমন এক পরিবেশ তৈরি হোক যেখানে ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তা কেউই অনিয়মে পার পেয়ে না যান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের অনেকেই অর্থপাচার করে বিদেশে নিয়ে গেছেন। ফলে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোরতায় কাজ হবে না। খেলাপিরা জানেন, মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা যাবে। তাঁরা ঘুষ দিয়ে মামলা পিছিয়ে দিচ্ছেন। ঋণখেলাপির এই চক্র থেকে বের হতে হলে খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল করতে হবে কিংবা সুপ্রিম কোর্টের সুনির্দিষ্ট বেঞ্চ গঠন করে এঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে নিয়মিত দেখানো আগের তুলনায় এখন কঠিন করা হয়েছে। যদিও আগের স্থগিতাদেশসহ হয়তো এ ধরনের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এখন আর আগের মতো অনেক বেশি সময়ও দিচ্ছেন না আদালত। অনেক ক্ষেত্রে কিছু ডাউনপেমেন্টের শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে স্থগিতাদেশের কারণে নিয়মিত দেখানো ঋণের তথ্য জানানো হচ্ছে। এভাবে চললে খেলাপি ঋণ সমস্যার সমাধান আসতে পারে।