Image description

পাহাড় টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ঐক্য অপরিহার্য। সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শুধু প্রশাসনিকভাবে নয়, মানবিক ও জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখতে হবে। একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘিরে আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্র রুখে দিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে আরো সেনা সদস্য মোতায়েন করতে হবে।
সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব থাকলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব টিকে থাকে না। গতকাল বুধবার রাজধানী মহাখালীতে রাওয়া হেলমেট হলে ‘সমস্যাসংকুল পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তির অন্বেষণ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনাসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

বক্তারা বলেন, পাহাড়ে বাঙালিদের সেটলার বলে অভিহিত করা বন্ধ করতে হবে। সেটলার বলে কিছু নেই।
সবাই বাংলাদেশি। পাহাড়ি হিসেবে না দেখে বাংলাদেশি হিসেবে দেখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়ে ভারত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ন্যারেটিভ তৈরি করে। যারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইবে তারা সন্ত্রাসী।
শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল যখন তখন সেটা ভারতের প্রেসক্রিপশনে নতজানু সরকার ওই চুক্তি করেছিল। এই চুক্তির মাধ্যমে সন্তু লারমাকে ক্ষমতায়িত করেছেন হাসিনা। এই চুক্তি সংশোধন এবং সম্ভব হলে বাদ দেওয়া উচিত।

সভায় রাওয়ার চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুল হক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা যেমন বৈষম্যের শিকার, তেমনি সেনাবাহিনীও। এই বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বের করতে হবে জাতীয়ভাবে।
এ সময় পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ি ও বাঙালি এক না হওয়া পর্যন্ত শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহের কথা জানান তিনি।

মূল প্রবন্ধে মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, বীরের জাতি বাংলাদেশিদের মনোবল হারানোর কোনো কারণ নেই। শান্তি চাইলে অশান্তি দূরীকরণে যুদ্ধের যথাযথ প্রস্তুতি থাকতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সমরনীতির ক্ষেত্রে স্থায়ী বন্ধু ও স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই, একমাত্র স্থায়ী নিজ দেশের স্বার্থ। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন যতই থাকুক না কেন, বহিঃশত্রু মোকাবেলায় এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে জাতিগত ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। বিদেশি গোয়েন্দাদের প্রলোভন ও জাল থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

কর্নেল জয়নুল আবেদীন (অব.) বলেন, পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী থাকতে হবে। এই বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। প্রত্যাহার করা ক্যাম্পগুলো আবারও চালু করতে হবে।

বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ফ্লাইং করেছি। তখন আমি দেখেছি, বাংলাদেশ আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখতে কত প্রাণ দিয়েছে, সে কারণে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অংশ হিসেবে রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম স্পেশাল প্লেস। এখানে আর্মির কারণেই সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা এখনো বজায় রয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা তখন ৪০০ ক্যাম্পে ফ্লাইং করেছি। সেই ক্যাম্পের সংখ্যা কোথায় নেমে এসেছে? আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ১৯৮০ সাল অথবা ১৯৯০-এর দিকে যে ব্যবস্থাপনা ছিল, সে অর্ডারটা আমাদের এস্টাবলিশ করতে হবে।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) তুষার ক্লান্তি চাকমা বলেন,     ‘সাইকেল চুরির মতো ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হয়, কিন্তু যখন পার্বত্য এলাকায় হয় তখন সেখানে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার ইন্ধন জোগানো হয়। আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সে কথা সরাসরি বলে এসেছেন, কারা কারা ইন্ধন দেন এবং কীভাবে দেন। কিন্তু যদি একটি সিস্টেম থাকত, যখনই কোনো ধরনের ঘটনা সাম্প্রদায়িক রূপ নিতে পারে, সেটা যদি প্রশাসন থেকে জাতীয় পর্যায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না।’

দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘পাহাড়ে ভারত বাংলাদেশে তাদের আগ্রাসন জিইয়ে রাখার জন্য অস্ত্র বানিয়ে রেখেছে এবং সেই অস্ত্র সময় সময় সুযোগ মতো ব্যবহার করছে। যখন তাদের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় থাকবে না তখন তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করবে।’

যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ও কবি আব্দুল হাই শিকদার বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমাদের ভূমিকা অত্যন্ত অদূরদর্শী ও দুঃখজনক। আমাদের সেনাবাহিনী সেখানে প্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিত, পুরোটার পেছনে কোনো পরিকল্পনা নেই, এ জন্য সেখানের সমস্যা দূর করা যাচ্ছে না।’

মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী (অব.) বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম তখনই উত্তপ্ত হয় যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তপ্ত করার কাজে জড়িত পার্শ্ববর্তী দেশ।

এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ হোসাইন (অব.) বলেন, বাংলাদেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে অবিলম্বে অপারেশন এরিয়া ঘোষণা করতে হবে।

লে. কর্নেল (অব.) ইউ খান থেইন বলেন, পাহাড়ে চাঁদাবাজি, খুন, ছিনতাই বেড়ে চলেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে এবং শান্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে গুজব। ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, সামাজিক উন্নয়ন, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, গুজব ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। সম্প্রীতি ও আলাপ-আলোচনার মধ্যেই সমাধান নিহিত।

আলোচনাসভায় সিএইচটি সম্প্রতি জোটের প্রধান সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার থোয়াই চিং মং শাক বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বললেই মনে করি, চাকমা। সন্তু লারমার একটা বাহিনী ছিল—জেএসএস। সেই জেএসএস থেকে আজ সাতটা দল তৈরি হয়েছে। এই দলগুলো তৈরির পেছনে কারণ কী? আমরা রাঙামাটিকে লিজ দিয়েছি চাকমাদের হাতে, বান্দরবানকে লিজ দিয়েছি মারমাদের হাতে আর খাগড়াছড়িকে লিজ দিয়েছি ত্রিপুরাদের হাতে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারিনি, তার একমাত্র কারণ এই তিনটি জাতির কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম লিজ দেওয়া আছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, নয়তো পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলতেই থাকবে।’ তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সেটলার—এ শব্দগুলো বাদ দিতে হবে। যে পাহাড়ে বসবাস করে তারাই পাহাড়ি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিরসনে সবার মধ্যে সমবণ্টন করতে হবে। পাহাড়ে ভূমিহীনদের ভূমির ব্যবস্থা করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাকেন্দ্রিক স্বপ্ন না দেখে সব জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তবেই পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বা পশ্চিমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারবে না।