
রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা পুরনো সমস্যা। এই ভোগান্তি থেকে নগরবাসীর মুক্তির জন্য অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বাস্তবে কোনো সমাধান মিলছে না। পরিস্থিতি পাল্টাতে দুই সিটিতেই খাল উদ্ধারের কর্মসূচি চলমান। গত কয়েক মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ২৯টি খালের সীমানা চিহ্নিত এবং প্রায় এক হাজার ৩০০টিরও বেশি সীমানা পিলার স্থাপন করেছে।
এবার সেই সীমানা ধরে দখল উচ্ছেদ ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলরা।
ডিএনসিসির পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপক খনন ও পরিষ্কার কাজ করা হয়েছে। কল্যাণপুর, বেগুনবাড়ী, মহাখালী, ইব্রাহিমপুরসহ গুরুত্বপূর্ণ খাল থেকে মোট এক লাখ ২৩ হাজার ৫৬৪ ঘনমিটার স্ল্যাজ ও আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে। ফলে পানি ধারণক্ষমতায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির আশা করছে সংস্থাটি।
একইভাবে ওই অর্থবছরে মোট ২৪ কিলোমিটার খাল পরিষ্কারের কাজ সম্পন্ন হওয়া এবং স্টর্মওয়াটার লেন ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা হয়েছে।
ডিএনসিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে খাল ও ড্রেনেজ লাইনের নিয়মিত পরিচ্ছন্নতায় ৩৬০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীলতার জন্য ১০টি অঞ্চলভিত্তিক মোট ২০টি কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমের সদস্যরা হঠাৎ বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় খালের ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার করে দ্রুত জলাবদ্ধতা কমাতে সহায়তা দেবেন।
সংস্থাটি জানিয়েছে, উত্তরে সম্প্রতি ২২১.৮৫ কিলোমিটার স্টর্মওয়াটার লেন এবং ১.৫৪৭ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা হয়েছে।
এতে বৃষ্টির পানি সহজে নামবে। এ ছাড়া চলতি বা আগামী অর্থবছরে আরো রাস্তা ও নদীর উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে প্রায় ১১০ কিলোমিটার রাস্তা ও ১০৫ কিলোমিটার নর্দমা বা নদীপথ উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
উত্তরে জলাবদ্ধতার স্থান ও পরিস্থিতি : ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রস্তুতকৃত ওয়াটার লগিন অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী অন্তত ২৯টি খাল ও আশপাশের এলাকা জলাবদ্ধতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কিছু স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে মহাখালী, বেগুনবাড়ী, ইব্রাহিমপুর, কাওলা, কালশী, কাটাসুর, বাইশরিকী, কুর্মিটোলা, সানারপাড় ও বাউসিয়া খালসংলগ্ন এলাকাগুলোতে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি দ্রুত নামতে না পারায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা হয়। কর্তৃপক্ষ বলছে, মহাখালী ও বেগুনবাড়ী খাল এলাকায় ঘনবসতি ও ড্রেনেজ লাইন ভরাট থাকায় মাঝারি বৃষ্টিতেই সড়ক হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে যায়।
ইব্রাহিমপুর ও কালশী খাল এলাকায় খালের প্রবাহ সংকুচিত হয়ে আশপাশের রাস্তা ও বাড়িঘর প্রায়ই পানিতে ডুবে যায়। কাওলা ও কুর্মিটোলা খাল সংলগ্ন উত্তরা অংশে বিমানবন্দরসংলগ্ন সড়কে জলাবদ্ধতা তীব্র আকার ধারণ করে, যার ফলে যানজট ও জনভোগান্তি বাড়ে। এ ছাড়া কল্যাণপুর খাল এবং রামপুরা এলাকায় ঢাকার পশ্চিমাংশে বৃষ্টির পানি জমে দীর্ঘ সময় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। কারণ খাল ভরাট ও স্ল্যাজ জমে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘সীমানা নির্ধারণ ও পিলার স্থাপন একটি বড় প্রযুক্তিগত ও আইনি পদক্ষেপ। এটা শেষ হওয়ায় এবার আমাদের কাজ হবে দখল উচ্ছেদ, নিয়মিত তদারকি ও টেকসই রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা। আমরা চাই না যে উদ্ধার করা খালগুলো কেবল নামমাত্র মুক্ত থাকুক; এগুলোকে নাগরিকদের জন্য সবুজ ওয়াকওয়ে ও পরিবেশবান্ধব করা হবে। এ জন্য স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও আইনি সহায়তা দুটিই জরুরি।’ তিনি আরো জানান, খাল উদ্ধারে সফলতা ধরে রাখতে ডিএনসিসি অতিরিক্ত প্রযুক্তি ও জনবল চাচ্ছে। ১৭৫টি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হচ্ছে, যাতে জিআইএসভিত্তিক হটস্পট ম্যাপিং, মাস্টার ড্রেনেজ প্ল্যান বাস্তবায়ন এবং নিয়মিত পরিদর্শন শক্তিশালী করা যায়।
জানা গেছে, ভবিষ্যৎ কর্মসূচি হিসেবে ডিএনসিসি বাইশরিকী, সানারপাড়, কুর্মিটোলা, ইব্রাহিমপুর ও বাউসিয়া খালের জন্য আলাদা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পে খাল খনন-পুনঃখনন, ওয়াকওয়ে নির্মাণ, সবুজায়ন ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। নিকট ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ঋণের সম্ভাবনাও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু খাল খনন করলেই হবে না, নিয়মিত পরিষ্কার, নির্ভরযোগ্য অপারেশনাল বাজেট, আইন-শৃঙ্খলা ও স্থানীয় জনগণের সচেতনতা নিশ্চিত করতে হবে। ডিএনসিসির পরিকল্পনায় এসব দিককে গুরুত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি, পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আবহাওয়া উপযোগী ও টেকসই নগর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে খাল রক্ষার ধারা অবিচ্ছিন্ন রাখা আবশ্যক। খাল শুধু পানি নেওয়ার নালিকা নয়, এগুলো ঢাকার বাসযোগ্যতা, সৌন্দর্য ও পরিবেশগত ভারসাম্য নিশ্চিত করার কৌশল। আমাদের ড্রেনেজ এবং পুরনো ব্যবস্থাপনায় জলাবদ্ধতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব না হলেও সঠিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে ভোগান্তি কমতে পারে।’