
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে প্রণয়ন হতে যাওয়া ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে যতই আলোচনা হচ্ছে, ততই নতুন নতুন প্রস্তাব যুক্ত হচ্ছে। এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের সিদ্ধান্ত হলেও সেই গণভোট কবে ও কিভাবে হবে, তা নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের প্রস্তাব রেখেছে বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল।
গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের সংলাপে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
জুলাই সনদ বাস্তায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমতের অংশগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদে যে বিষয়গুলো আছে সেখানে যেহেতু কিছু ‘নোট অব ডিসেন্ট’ আছে, সেটাকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সবই একভাবে বিবেচনা করা যাবে, তা আমরা মনে করছি না।
কমিশন সূত্র জানায়, সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর গণভোটের সময় ও বিষয়বস্তু নিয়ে ভিন্নমত তুলে ধরে। বিক্ষিপ্ত আলোচনায় অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে কমিশন ও সরকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহবান জানায়। তারা মনে করে, এই ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে না। কেউ কেউ জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবি জানালেও অধিকাংশই মনে করে, এতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হবে। ভোটার উপস্থিতি ১০-১৫ শতাংশ নেমে আসবে, এতে সর্বস্তুরের জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না। এমনকি জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। যা নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে অর্থ সাশ্রয় হবে। আর জুলাই সনদ গণভোটে পাস হলে সংসদের প্রথম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে।
সংলাপ থেকে বেরিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে একমত দলগুলো। তবে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন আলাদা বিষয়। তাই জাতীয় নির্বাচনের আগে নভেম্বরের শেষদিকে গণভোট দিতে হবে। আমাদের কাছে রেকর্ড আছে, বাংলাদেশে ১৯ দিনের ব্যবধানেও গণভোট হয়েছে, এক মাসের ব্যবধানেও গণভোট হয়েছে। আজ অক্টোবরের ৮ তারিখ। অক্টোবরের আরো ২০ দিন আছে। নভেম্বরে যদি আমরা আরো ১৫ দিন ধরি, তাহলে ৩৫ দিন। নভেম্বরের ১৫ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে যদি আপনি গণভোট করে ফেলেন, দেড় মাস, এটা ভেরি এনাফ টাইম। আর নভেম্বরের শেষের দিকে বা ডিসেম্বরের ফার্স্ট উইকে যদি আপনি জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন, তাহলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট সময় আছে।
আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘অনেকে বলেছেন, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে হলে ভালো। আমরা বলেছি, না, গণভোট আলাদা বিষয়, জাতীয় নির্বাচন আলাদা বিষয় এবং দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গণভোট হবে আমাদের যেসব সংস্কার হচ্ছে, জুলাই সনদ হিসেবে যেটাকে প্যাকেজ হিসেবে আমরা হ্যান্ডেল করছি, সেটাকে নিয়ে। সুতরাং গণভোটটা আগেই হয়ে যাওয়া দরকার। জনগণ যদি গ্রহণ করে, সেই গণভোটের ভিত্তিতেই পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো হবে, নির্বাচন হবে। আর জনগণ যদি রিজেক্ট করে দেয়, তাহলে তো সেটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত আমাদের টেনশনে ঘুম আসেনি। কারণ ওখান দিয়ে ধাক্কা মারে, এখান দিয়ে মিছিল করে, ওখানে অভিযোগ করে। তো ইলেকশনটা সুষ্ঠুভাবে হওয়ার পরেও সহজে মেনে নেওয়ার যে মানসিকতা, এটা কিন্তু আমরা দেখতে পাইনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে ৪৮ ঘণ্টা পরে রায় দিয়েছে। তাহলে দুইটা নির্বাচন আমাদের এ রকম একটি আশঙ্কা দেয় যে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে এখনো মনমানসিকতায় আমরা তৈরি হতে পারিনি। এখন কোনো কারণে যদি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু না হয়, একই দিনে যদি আমি জুলাই চার্টারের ওপরে গণভোট করি, তাহলে সেটাও তো সুষ্ঠু হবে না। সুষ্ঠু যদি না হয়, তাহলে জুলাই চার্টারের রিফর্মসের যে ডিসিশনটায় আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, সেটাও এখানে কার্যকর হবে না। আরো কিছু দল নভেম্বরের ভেতরেই গণভোটের পক্ষে আছে বলে তিনি জানান।
একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের পক্ষে অবস্থান তুলে ধরে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নভেম্বর বা ডিসেম্বরের শুরুতে গণভোট করলে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হবে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। গণভোটে ভোটার উপস্থিতি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নেমে আসতে পারে। এতে জুলাই সনদের ওপর সর্বস্তরের মানুষের মতামতের প্রতিফল ঘটবে না। সে ক্ষেত্রে একইসঙ্গে ভোট হলে ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়বে। এতে রাষ্ট্রীয় অর্থ সাশ্রয় হবে। তাই দ্রুত আলোচনা শেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে পাঠানো উচিত।
গণভোট প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আহবান জানান আমার বাংলা (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, আমরা ভেবেছিলাম, কমিশন আগে যেটা প্রস্তাব করেছিল, একই দিনে নির্বাচন, সেটার ব্যাপারে ঐকমত্য আছে। কিন্তু আজকে লক্ষ্য করলাম, দুই ধরনের মতামত আছে। দুই পক্ষের বক্তব্যের মধ্যেই আমরা যুক্তি খুঁজে পেয়েছি। তাই কমিশনকে বলেছি, যেহেতু ঐকমত্য হচ্ছে না, তাই আপনারা মাঝখানে রেফারির ভূমিকা হিসেবে যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিন। জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট হলে আমাদের আপত্তি নেই।
তিনি বলেন, কিছু কিছু শক্তি বা ব্যক্তি আছে, তারা আসলে বিভেদ চায়, অনৈক্য চায় এবং একটা হাঙ্গামা ও বিপর্যয় চায়। আমাদের এই ইগো সংকটের কারণে মনে হচ্ছে, পরোক্ষভাবে আমরা সীমান্তের ওপারের ইচ্ছাটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। এখানে আরেকটা বিষয় হচ্ছে, অধ্যাদেশ হবে, নাকি জুলাই সনদ আদেশ হবে?
তিনি আরো বলেন, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নিজেদের সরকারের অংশ মনে করে। আমরা মনে করি তাদের কারণে একমত হওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জনগণ ঐকমত্য চায়। সংবিধান আদেশ বা বিশেষ আদেশ যেভাবেই হোক।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, আরো এক মাস এভাবে আলোচনা করলেও আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারব না। রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্নমতকে একমত করতে কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি শেখ হাসিনার সঙ্গে পাঁচজন উপদেষ্টা হাত মিলিয়েছেন। তাঁরা শেখ হাসিনার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। ঠিক একইভাবে আজকের এই আলোচনা দেখে মনে হচ্ছে, আমরাও শেখ হাসিনার হাতে হাত মিলিয়েছি। জাতীয় নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদের পক্ষে গণভোট একই দিনে হতে হবে। আগে যারা এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিল, তারাও এখন বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট। তিনি আরো বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে, প্রথম যে অধিবেশন সেই অধিবেশনে জুলাই জাতীয় সনদের অনুমোদন দিতে হবে। অর্থাৎ গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা সেই আকাঙ্ক্ষা জনগণ পূরণ করল ভোট দেওয়ার মাধ্যমে এবং যেদিন প্রথম অধিবেশন হবে, সেদিন এটার অনুমোদন দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ অক্টোবর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়নে ‘গণভোট’ প্রশ্নে একমত হয় রাজনৈতিক দলগুলো। তবে ভোটের সময় ও কিভাবে হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়াও বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করে কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের কাজ সম্পন্ন করার কথা জানানো হয়। গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয় এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করে কমিশন। ছয় মাস মেয়াদের কমিশন ১৫ আগস্টের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারায় মেয়াদ ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর পরও দ্বিতীয় দফায় কমিশনের মেয়াদ আরো এক মাস বাড়িয়ে ১৫ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়।