
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ৪ মিলিয়ন ইউরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৫৬ কোটি ৮৫ লাখ। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এই টাকা কোনো কাজে আসবে না। কারণ, মূলত এই টাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক দল ও বিভিন্ন এনজিও’র পেছনে ব্যয় করা হবে।
ইতোমধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে ৫ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। টাকার অঙ্কে ৫৬ কোটি টাকা খুবই সামান্য। স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের পর ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত মিলারের কথা ও কাজের মধ্যেও দ্বিচারিতার ইঙ্গিত লক্ষ্য করা গেছে। হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিলেও ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার দ্রুত নির্বচন দীর্ঘায়িত করার জন্য যথেষ্ট প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছেন। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তিনি নানা কায়দায় নির্বাচনকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টাও করেছেন। কেউ কেউ তার এই ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছেন, ইইউ রাষ্ট্রদূত মূলত নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে আওয়ামীলীগকে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিশ্রুতির নেপথ্যে তাদের স্বার্থই হাসিল করতে চয়। একদিকে তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহযোগী হিসাবে নিজেদেরকে জাহির করতে চায়, অন্যদিকে, তৈরি পোশাক রফতানির মূল্য কমাতে সচেষ্ট। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যা এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গা সমস্যাকে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ মনে করে, পক্ষান্তরে তারাই আবার রোহিঙ্গাদের জন্য ফান্ড দিন দিন কমিয়ে দিয়েছে। একদিকে তারা মুখে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দাবি করে, বিপরীতে তারাই আবার অভিবাসন নীতি কঠোর করেছে। এতে করে ইউরোপের দেশগুলোতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। অনেকের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর একটি চার্টার্ড ফ্লাইটযোগে ইইউ ২৯ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়েছে। এর আগে মার্চ মাসেও একইভাবে ৬০ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। কূটনৈতিক সূত্র দাবি করেছে, ইইউ’র কঠোর অভিবাসন-নীতির কারণে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন। এতে করে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সে বড় প্রভাব পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও তারা কয়েক মাস আগে দাবি করেছিল জনশক্তি আমদানিতে নিরাপদ দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এসব দ্বিচারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামতগুলো বিভিন্ন দিকে বিভক্ত। তবে প্রধানত এটি তাদের নীতি এবং বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে পার্থক্যকে নির্দেশ করে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইইউ অভ্যন্তরীণভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে কথা বললেও, বাস্তবে তারা সদস্য দেশগুলোতে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিন্ন আচরণ করে। অন্যদিকে, অনেকে মনে করেন যে ইইউ-র অভ্যন্তরীণ কাঠামো, যেমন আইন, অর্থনীতি, বাণিজ্য, এবং অভিবাসন সংক্রান্ত নীতিগুলি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি দ্বিচারিতা দেখা যায়, যা তাদের নিজস্ব লক্ষ্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।
দেশ থেকে সমাধান চাইলেও বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চার মিলিয়ন ইউরোর একটি সহায়তা প্যাকেজ দেবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। বৈঠকে ছয় সদস্যের একটি ইইউ প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। মাইকেল মিলার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করছে যাতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সহায়তা নিশ্চিত করা যায়। তিনি বলেন, আমরা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির দিকে এগোচ্ছি। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে চার মিলিয়ন ইউরো সহায়তা প্যাকেজ দিচ্ছি। তিনি আরও জানান, ইইউ’র এই সহায়তা প্যাকেজের আওতায় নির্বাচন পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধি, নাগরিক পর্যবেক্ষণ জোরদারকরণ, অপারেশনাল পরিকল্পনা এবং বিরোধ নিষ্পত্তিসহ নানা ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা হবে। এই নির্বাচন পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ জোরদারের লক্ষ্যে কাজ করছে কিছু এনজিও।
এদিকে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন প্রায় ৫ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। ইসির অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ জানিয়েছেন, মোট বরাদ্দের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৮০০ টাকা জাতীয় নির্বাচনের জন্য ব্যয় করা যেতে পারে। এই টাকার সাথে তুলনা করলে ইইউ’র ৫৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা খুবই সামান্য।
হাসিনার পতনের পর বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকলে মিলার বরাবরই সংস্কারের অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর জন্য সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিডিয়ার সামনে তিনি দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সংস্কারের প্রতি জোর দিয়েছেন। এতে করে দিন দিন রাজনীতিতে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়তে থাকে। ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে সাধুবাদ দিতেও কার্পণ্য করেনি। যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের চাপের মুখে নির্বাচন পেছানোর দাবি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই। জাতীয় নির্বাচন কখন হবে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের। তবে সংস্কারগুলো সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কারণ টেকসই বাংলাদেশ নির্মাণে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কখন হতে পারে? উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে ইইউ কী চায়? নির্বাচন কমিশন, সরকার এবং অন্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনায় ইইউ কী বুঝতে পেরেছে? পররাষ্ট্র বিটের সাংবাদিকদের এমন কয়েকটি প্রশ্নের জবাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশে কখন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত সে বিষয়ে বাংলাদেশই সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তার আগে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ হওয়া উচিত, কারণ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। নির্বাচনের আগে সংস্কার চেয়ে ইইউ রাষ্ট্রদূত বলেন, এখানে আমি একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, তা হলো নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর আমাদের (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই। আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে কাজ করবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন ইইউর রাষ্ট্রদূত।
ওই অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে মাইকেল মিলার বলেন, রোহিঙ্গারা রাখাইনে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আমরা একটি রাজনৈতিক সমাধান চাই এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমরা মিলিটারি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। আমরা ২০১৭ থেকে ৫০ কোটি ইউরোর মতো সহায়তা দিয়েছি। এখন সহায়তার পরিমাণ কমে আসছে এবং এজন্য আমরা রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করতে চাইছি। এক প্রশ্নের জবাবে মাইকেল মিলার বলেন, ‘ইউরোপে পাচার হওয়া অর্থ যদি বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ফেরত আনতে চায়, তবে এ নিয়ে রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যোগাযোগ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি শেষ হতে তিন-চার বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ইইউর আমন্ত্রণে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বাধীন দলটির পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের ব্রাসেলস সফর বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেন, দলটির আগ্রহে আমরা জামায়াতের প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিচারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্নভাবে তুলে ধরেছেন। তাদের মতে, ইইউ নিজেকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু অনেক সমালোচক মনে করেন এটি তাদের অভ্যন্তরীণ নীতি এবং বহিঃবিশ্বে তাদের কার্যক্রমের মধ্যে অসঙ্গতি রয়েছে। ইইউ অভ্যন্তরীণভাবে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মানুষের অবাধ চলাচলের সুযোগ দেয়, কিন্তু বাহ্যিক ক্ষেত্রে অভিবাসীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের প্রতি আচরণ নিয়ে অনেক সময় দ্বিচারিতা দেখা যায়। ইইউ-র কিছু সদস্য দেশ অনেক ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় বেশি সুবিধা ভোগ করে, যা ইইউ-এর অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে একটি বৈষম্য তৈরি করে। এ ছাড়া ইইউ-এর বৈদেশিক নীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও দ্বিচারিতা পরিলক্ষিত হয়, কারণ এটি কখনো কখনো তার সদস্য দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা করে এবং অন্য সময় তা আন্তর্জাতিক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিছু বাণিজ্য নীতির ক্ষেত্রে ইইউ নিজস্ব স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি দ্বিচারিতা সৃষ্টি করে। বিকেএমই-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য বাজারেও কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। তারা চায় রফতানি পোশাকের দাম কমিয়ে দিতে। চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এসব বাজারে রফতানি বাড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন শুল্ক কাঠামোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে রফতানি পুনরুদ্ধার হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইইউ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, এর সদস্য দেশগুলির কিছু কার্যক্রম, যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, এই লক্ষ্যের পরিপন্থী। সংক্ষেপে বলা যায়, ইইউ-র দ্বিচারিতা একটি জটিল বিষয় এবং বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এই বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে, এটি স্পষ্ট যে ইইউ তার অভ্যন্তরীণ নীতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার কার্যক্রমের মধ্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব একজন কর্মকর্তার মতামত জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তার ভাষায় এটি খুবই সেনসিটিভ বিষয়। এ বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। কারণ ইইউ তাদের পলিসি মতোই কাজ করার অধিকার রাখে।