Image description
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে ফের রাজনীতিতে ফেরানোর চেষ্টা?, দেশকে ‘ডল হাউজ’ এ পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে : অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ, নির্বাচন চাচ্ছেন দিলাম নির্বাচন এই চালাকি হলো গণভোট : জাহেদ উর রহমান

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর সব চেষ্টা ভ-ুল হওয়ার পর এবার গণভোট বিভ্রম! ক্ষমতার মধু কি এতোই মিষ্টি যে চেয়ার ছাড়তেই মন চায় না? গণভোটের নামে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে রাজনীতে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে কারা? আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা মানুষের মুখে মুখে এখন এ প্রশ্ন। ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ হলে মানবে না এমন বক্তব্য কি কেউ দিয়েছে? কেউ কেউ অবশ্য আশঙ্কা করছেন, গণভোটের নামে ‘নির্বাচন হয়েছে’ বার্তা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার এ কেমন পায়তারা?

সম্মতি উৎপাদনে ব্যর্থ ‘পি.আর. পদ্ধতি’র ধুয়া মাঠে মারা যাওয়ার পর নতুন ধুয়া তোলা হয়েছে ‘গণভোট’র। ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ প্রশ্নে সামনে টেনে আনা হচ্ছে ‘গণভোট’ প্রসঙ্গ। দু’য়েকটি চিহ্নিত রাজনৈতিক সংগঠন অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই একের পর এক ‘ফলস বল’ ছুড়ে দিচ্ছে। উদ্দেশ্য আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করা। প্রশ্নবিদ্ধ করা। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন অনিশ্চিত করে তোলা। যা উৎখাত ও নিষিদ্ধ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে রাজনীতে প্রত্যাবর্তনের পথ তৈরি করবে। ভারতীয় নীলনকশারই বাস্তবায়ন হবে। এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন আইনজ্ঞ এবং বিশ্লেষকরা।

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, গণভোট, পিআর এসব মূলতঃ নানা কায়দা-কানুনের মধ্য দিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার প্রয়াস। অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দেশ-বিদেশে সবখানেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। এর মাঝে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আলোচনা সভা করা। রাজপথে একই ইস্যুতে আন্দোলন করা। মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পি.আর.) পদ্ধতি সম্পর্কে ভুল বোঝানো। ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ ইস্যুতে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার পক্ষে নতুন যে ধুয়া তোলা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে এসব মোকাবেলা করাই বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার কী দল বিশেষের দাবী অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনের আগে পৃথক গণভোট করার ফাঁদে পা দেবে?

গণভোট দাবির চাতুরিতা তুলে ধরে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ উর রহমান নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন, মার্কিনীরা চায় নির্বাচন, জাতিসংঘ চায় নির্বাচন, দেশের সব রাজনৈতিক দল, জনগণ চায় নির্বাচন। যারা অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায়, আরো বেশি দিন উপদেষ্টা পদ, অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকতে চায় তারা মূলত এই ‘গণভোট’ ইস্যু হাজির করেছেন। ভাবখানা নির্বাচন চাচ্ছেন দিলাম নির্বাচন। গণভোট দেখিতে জাতি ও বিদেশিদের বোঝানো যে সবাই ভোট চায় তাই বাংলাদেশে ভোট হয়েছে। জাতিকে এতো বোকা ভাবেন কেন? জাতি কি কখনো গণভোট চেয়েছে? জনগণ নিজেদের প্রতিনিধিত্ব চায় ভোট দিয়ে নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও পুঁজি ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তায় নির্বাচিত সরকারের অধীনে বিনিয়োগ করতে চায়।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের প্রস্তুতি যখন চলছে; তখন ‘জুলাই জাতীয় সনদ’র বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার একাধিক প্রস্তাব প্রদানের মাধ্যমে কালক্ষেপণের কৌশল নিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কৌশল কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধিসহ রাজনৈতিক দল বিশেষকে নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেয়ার অভিলাষ থেকেও হতে পারে। যদিও জুলাই জাতীয় সনদের আইনগত ভিত্তি প্রদানে সংলাপে অংশ নেয়া ৩০টি রাজনৈতিক দলই এক মত। শুধুমাত্র জামায়াতসহ কয়েকটি ছোট দল জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট (জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে) ও সাংবিধানিক আদেশের কথা বলছে। জাতীয় নির্বাচনের ‘পূর্ব শর্ত’ হিসেবেও জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করছে তারা। তবে নিত্য-নতুন শর্ত, দাবি-দাওয়া জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে অবান্তর, অবাস্তব। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ নেই। চ্যালেঞ্জ এখন নিত্যনতুন আবদারে অন্তর্বর্তী সরকারকে ভ্রƒক্ষেপহীন থাকা।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সামনে বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকার অধ্যাদেশ জারি করে অথবা আরপিওতে সংশোধনী এনে গণভোট পরিচালনা করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দিতে পারে। নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন এই গণভোট করতে পারে। এতে একই আয়োজন, একই অর্থ ব্যয়, একই লজিস্টিকস, একবার ভোট সেন্টারে যাওয়ার সুবিধা পাওয়া যাবে। আবার পৃথক গণভোট নেয়ার পক্ষেও কথা বলছেন তিনি।

বিএনপি নেতার এমন বক্তব্যে অবশ্য দ্বিমতও পোষণ করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এটি খরচ এবং সময় সাশ্রয়ী হলেও যে উদ্দেশ্যে এ গণভোট সেই উদ্দেশ্যই ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পৃথক গণভোট আয়োজনের অসুবিধা হচ্ছে, আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো বিশাল আয়োজনের জন্য সরকারকে প্রস্তুতি নিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের একই দিন পৃথক ব্যালটে জাতীয় নির্বাচন এবং গণভোটের আয়োজন করা হলে মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়বে। কারণ মানুষ স্থানীয় সরকার, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই-তিনটি ব্যালটে ভোট দিতে অভ্যস্ত। সেগুলোতে মার্কা থাকে। মার্কা দেখে মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রার্থীর প্রতীকভিত্তিক প্রচারণা নিরক্ষর মানুষকে ভোট প্রদানের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। মানুষ তখন বুঝতে পারে কোন্ মার্কায় ভোট দিলে কে পাস করবে। পাস করলে ভোটারের কী লাভ কিংবা ক্ষতি হবে। গণভোটে সেটির বিস্তারিত ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।

২০২৪ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে দেশের সাত বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সী জনগোষ্ঠীর সাক্ষরতার হার দেখানো হয় ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের ২২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর। যদিও বিবিএস’র সমীক্ষায় অনেক সময় প্রকৃত বাস্তবতা উঠে আসে না। অনেক সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষও তার নিজের নামটি অন্যের হাতের লেখা থাকলে সেটি নিজেই পড়তে পারেন না। অনেক আছেন কোনোরকম নাম-দস্তখত দিতে পারলেও হৃদয়ঙ্গম করার মতো কন্টেন্ট পাঠ করতে অক্ষম। এমন বাস্তবতায় প্রতীক বা মার্কাহীন একটি ভোট (গণভোট) জুলাই জাতীয় সনদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনে কতটা কার্যকর সেই প্রশ্ন ওঠে।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে সর্বশ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ থাকলেও নেতৃত্ব ছিলো সচেতন ছাত্রদের হাতে। তারা হয়তো জানেন ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলে কী ধরনের উপকারিতা। অন্তর্ভুক্ত না হলে কী ধরনের ক্ষতি। কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ সেটি অনুধাবন করবে কীভাবে? জটিল গণভোটের চেয়ে মানুষ বরং সহজ সরল একটি জাতীয় নির্বাচনের জন্যই এখন উন্মুখ।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ বলেন, সংবিধান সংশোধন ছাড়া ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির দাবির বিষয়টি আমার কাছে মনে হয়, বাচ্চাদের খেলা। বাংলাদেশকে একটি ‘ডল হাউজ’এ পরিণত করার পাঁয়তারা চলছে। এসবের অন্য অর্থ হচ্ছে নির্বাচন না করা। ধরুন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে কি হবে না- এই বিষয়ে একটি গণভোট হলো। যে দেশের বহু মানুষ এখনো নিরক্ষর সে দেশের মানুষ বিষয়টি বুঝলো কি বুঝলো না, আপনি গায়ের জোরে গণভোট বা রেফারেন্ডাম একটি করে নিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো দল সরকার গঠনের পর যদি একটি আইন করে ওই গণভোট বাতিল করে দেয়? তাহলে যারা আজকে জুলাই জাতীয় সনদ প্রশ্নে গণভোট চাইছে তাদের তখন কি করার থাকবে ? ‘জুলাই জাতীয় সনদ’র তখন কী হবে? সুপ্রিমকোর্টের রায়ওতো পার্লামেন্টে বাতিল করা যায়। পার্লামেন্ট কি না করতে পারে?

আবার ধরুন সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের রেফারেন্ডাম নেয়া হলো। রেফারেন্ডামটা কীভাবে হচ্ছে একটি প্রশ্ন। রেফারেন্ডামে কী লেখা থাকছে একটি আরেকটি প্রশ্ন। জুলাই জাতীয় সনদের পক্ষে জন সম্মতি রয়েছে কি না, ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ যেটাই থাকুক, বিষয়টি জনগণকে বিস্তারিত বোঝাতে হবে। ব্যাপক হারে জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে। ‘হ্যাঁ’ হলে কি হবে ‘না’ হলেই বা কি হবে-মানুষকে জানাতে হবে। নির্বাচনের প্রশ্নে মানুষ বোঝে শুধু ‘মার্কা’। ‘হ্যাঁ’র মার্কা কী হবে ? ‘না’ এর মার্কা কী হবে ? এসব না বুঝিয়েই যদি গণভোট কিংবা সুপ্রিমকোর্টের রেফারেন্ডাম নেয়া হয়, আমার ধারণা সেটিও সাংবিধানিকভাবে বৈধ হবে না- বলে মনে করেন মহসিন রশিদ।

সিনিয়র এ আইনজ্ঞ পিআর পদ্ধতি এবং পরবর্তীতে গণভোট দাবিকে ‘বিভ্রম’ বলে উল্লেখ করেন। হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, যেখানে সুপ্রিমকোর্টের রায়, পার্লামেন্টে পাস করার আইনেরই কোনো শিউরিটি নেই- সেখানে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলে কী হবে ? ‘বাংলাদেশ বী কাম অ্যা ডল হাউজ’ মন্তব্য করেন অ্যাডভোকেট মহসিন রশীদ।

অন্যদিকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রশ্নে গণভোটের বিকল্পপন্থা অবলম্বনের মতামত দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো: দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যের অংশতঃ সমর্থন করে তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আদেশ বাতিলের মধ্য দিয়ে গণভোট আইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃজীবিত হয়েছে। এ আইন অনুসারেই পৃথক দিনে কিংবা জাতীয় নির্বাচনের দিন পৃথক ব্যালটে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে গণভোট করতে আইনি কোনো বাধা নেই। এটি হচ্ছে একটি বিষয়। আরেকটি বিকল্প হতে পারে, প্রভিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার (পিসিও)। পার্লামেন্টের অনুপস্থিতিতে অধ্যাদেশ জারি করে জুলাই জাতীয় সনদ’র আইনিভিত্তি দেয়া সম্ভব। সেটি যদি হয় জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের বিষয়েতো ঐকমত্য হয়েছেই। সে ক্ষেত্রে গণভোটেরও কোনো প্রয়োজন নেই। পরবর্তী সংসদ অধ্যাদেশটি রেটিফাই করে নিলেই হলো। আর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দল সরকার গঠন করে যদি জুলাই জাতীয় সনদকে রেটিফাই না করে তাহলে তো কিছুই করার নেই।