Image description
আজ জাতীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস

জন্মনিবন্ধন ঘিরে জটিলতায় বছরের পর বছর ভুগছেন নাগরিকরা। জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের দায়িত্ব রেজিস্ট্রার জেনারেলের হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সংস্থার আয় বাড়ানোর নামে একক সিদ্ধান্তে নিজস্ব সার্ভার চালু করেন। আইন অমান্যের এই উদ্যোগে দক্ষিণ সিটিতে ৭৯ হাজারের বেশি মানুষ সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন; নতুন করে আবার ফি দিয়ে নিবন্ধন করতে হচ্ছে তাদের। সংশ্লিষ্টরা এটিকে একজন নগরপিতার ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে দেখছেন। এরই মধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আজ জাতীয় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন দিবস পালন করছে।

ডিএসসিসির খিলগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ছেলে রাসেল রানার জন্মসনদ ফের তুলেছেন নাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগে জানলাম, সাবেক মেয়র তাপসের আমলে বিতরণ করা জন্মসনদ ভুয়া। বাচ্চাকে শিগগির স্কুলে ভর্তি করাতে হবে বলে আবার আবেদন করলাম। আগে ৫০ টাকা ফি নিয়েছিল, এবারও নিল। আগের টাকার কী হলো—জানতে চাইলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। দ্রুত সনদ চাইলে বলে, জাতীয় সার্ভার ঠিকমতো কাজ করে না।’ ধানমন্ডির বাসিন্দা ইমরান কবির অঞ্চল-১-এর কার্যালয়ে গিয়ে জানতে চান কেন তার ছেলের ‘ভুয়া জন্মসনদ’ দেওয়া হয়েছিল; সদুত্তর পাননি। ইমরান বলেন, ‘সনদটি আমার চার বছর বয়সী ছেলে মাসুদ কবিরের। পাসপোর্ট করতে গেলে অফিস থেকে জানায় সনদ ভুয়া, জাতীয় সার্ভারের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ নেই। সেবা দেওয়ার কথা সিটি করপোরেশনের; তারা উল্টো হয়রানি করছে। এখন বলছে নতুন করে আবেদন করতে।’

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নতুন আবেদনে সরকার নির্ধারিত ফি আবার দিতে হচ্ছে, ডিএসসিসির সার্ভারে আগের জমা টাকার কোনো ফেরত নেই। ওই সার্ভার থেকে দেওয়া মৃত্যুসনদও অকার্যকর হওয়ায় নতুন করে আবেদন করতে হচ্ছে।

ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সঙ্গে রাজস্ব ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ে শেখ ফজলে নূর তাপস নিজস্ব সার্ভারে জন্মসনদ বিতরণের বিতর্কিত উদ্যোগ নেন। তিনি বিভিন্ন সেবা সংস্থার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) করার চেষ্টা করেন; কিন্তু জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন-বিধি লঙ্ঘনের আশঙ্কায় কেউ সাড়া দেয়নি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি।

ঘটনার শুরু ২০২০-এ তাপস মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর। রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় জন্মসনদ বাবদ যে রাজস্ব পায়, তার ভাগ দাবি করে ডিএসসিসি; দ্বন্দ্বে ২০২৩ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ সিটিতে নিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ থাকে। নাগরিক ভোগান্তি বাড়ায় ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ডিএসসিসি নিজস্ব সার্ভারে সনদ বিতরণ শুরু করে এবং ফি সরাসরি পেতে থাকে। কিন্তু রেজিস্ট্রার জেনারেলের সার্ভারের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ না থাকায় শুরু থেকেই ভোগান্তি দেখা দেয়। ওই বছরের ১৯ অক্টোবর তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বিষয়টি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবকে লিখিতভাবে জানান। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. যাহিদ হোসেন বারবার চিঠি দিয়ে ‘নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধন’কে আইনবহির্ভূত বলেন। এ সময় ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গোপনে দেশ ছাড়েন; এরপর জাতীয় সার্ভার থেকে সনদ বিতরণ আবার চালু হয়।

ডিএসসিসির আইটি বিভাগের তথ্যমতে, তাপসের নির্দেশে প্রায় সাড়ে ১০ মাসে ৭৮,৯৫৬টি জন্মনিবন্ধন ও ১,৪৭১টি মৃত্যুনিবন্ধন দেওয়া হয় এবং প্রায় ৪০ লাখ টাকা রাজস্ব আসে। বর্তমানে ডিএসসিসির ৭৫টি ওয়ার্ডে ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে আবেদন করে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কার্যালয়ে জমা দিতে হয়।

নিজস্ব সার্ভারের সনদে স্কুল-কলেজে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করা যায়নি—জাতীয় সার্ভারের সঙ্গে কোনো আন্তঃযোগাযোগ না থাকায় তথ্য যাচাই অসম্ভব ছিল। ফলে সরকারি সেবা নিতে গিয়ে হয়রানি বেড়েছে। উপায়ান্তর না দেখে দক্ষিণ সিটির বাসিন্দারা জাতীয় সার্ভারে ফের আবেদন করছেন। ডিএসসিসির অঞ্চল-২-এর রেজিস্ট্রেশন সহকারী (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) মো. সাজহার উদ্দিন বলেন, ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের জাতীয় সার্ভারে দিনে চাপ খুব বেশি। ইন্টারনেটের গতি ভালো থাকলেও ঢোকা যায় না। তাই দিনের আবেদনগুলো রাতেই কাজ করতে হয়।’ অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু আসলাম বলেন, ‘স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। করপোরেশনের সার্ভার থেকে যারা সনদ নিয়েছেন, সবাই ভোগান্তিতে পড়েছেন। এমন অভিভাবক প্রতিদিন আসছেন; তাদের কাজকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এখন অনেকেই বিষয়টি বুঝে নতুন করে আবেদন করছেন।’

আইন অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ সরকারি সেবা পেতে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সঙ্গে এমন ২২টি সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের এমওইউ রয়েছে—জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন, ২০০৪-এর ৭(ক)(২) ধারা এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা, ২০১৮-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯(২) ধারার ভিত্তিতে। ৭(ক)(২) ধারা রেজিস্ট্রার জেনারেলের দায়িত্ব-কার্যাবলি বিধিতে নির্ধারিত বলে; আর বিধিমালার ১৯(২)-এ সফটওয়্যার নির্মাণ-রক্ষণাবেক্ষণ এবং সেই সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয় ভান্ডারে সংরক্ষণের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের—ডিএসসিসির উদ্যোগের তাই কোনো আইনি ভিত্তি ছিল না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘যেখানে জাতীয় সার্ভার রয়েছে, সেখানে করপোরেশনের সনদ বিতরণ করা ঠিক হয়নি। যোগ দেওয়ার পর এ বিষয়ে অনেক অভিযোগ পেয়েছি; আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি—আগে যারা সনদ নিয়েছিলেন, তারা ফের আবেদন করলে আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিতে।’ আগের ফি কেন ফেরত বা সমন্বয় করা হয়নি—এ প্রশ্নে তার জবাব, ‘ফেরত বা নতুন আবেদনে যুক্ত করা গেলে ভালো হতো। কিন্তু টাকা কীভাবে নেওয়া হয়েছে, কোন খাতে আছে, তা জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব।’