
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনের ২৪ ঘণ্টা আগেও দেখা গেল নতুন নাটক। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতের দেওয়া নতুন আদেশে ভোটাধিকার ফিরে পেয়েছে ঢাকার ১৫ ক্লাব। একই সঙ্গে আজ নির্বাচন আয়োজনেও কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আদালত। কিন্তু এরই মধ্যে নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তুলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছেন ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের সংগঠকরা। এ ছাড়া বিসিবি নির্বাচন নিয়ে উচ্চ আদালতে দুটি রিট করা হলেও তাতে চূড়ান্ত রায় আসেনি। এমন ঘোলাটে পরিস্থিতির পর নির্বাচন হলেও অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়েই কাউন্সিলরদের ভোটে গঠিত হবে নতুন পরিচালনা পর্ষদ। আজ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেলে হবে ভোটগ্রহণ ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা। এদিকে শুক্রবার গভীর রাতে গ্রহণ করা ২৪টি ই-ভোট বাতিল করে কাউন্সিলরশিপ ফিরে পাওয়া ইফতেখার রহমান মিঠুর নাম অন্তর্ভুক্ত করে তৈরি করা হয় নতুন ব্যালট। সেই ব্যালটেই ই-ভোট গ্রহণ করা হয়েছে গতকাল রোববার রাতে। এতসব বিতর্কের পরও এই নির্বাচন ঠিকঠাক হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নে বিসিবি প্রেসিডেন্ট আমিনুল ইসলাম জানালেন, ‘ঠিকঠাক ভোট হচ্ছে কি না, এটা নির্বাচন কমিশন বলতে পারবে। ভোটে তো আপস অ্যান্ড ডাউন থাকবেই এবং এটা আমার জন্য প্রথম। হয়তো ভাবছি, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।’
বিসিবি এবারের নির্বাচন বিভিন্ন আলোচনার জন্ম দিয়েছে ক্ষণে ক্ষণে। তপশিল ঘোষণা থেকেই ছিল বিতর্ক। তিন দফায় কাউন্সিলর চেয়ে জেলা, বিভাগ ও ক্লাবগুলোকে চিঠি পাঠিয়েছে বিসিবি। বারবার নাম পরিবর্তনও হয়েছে তালিকাগুলোতে। তপশিল ঘোষণার পর নির্ধারিত সময়ে কাউন্সিলর তালিকা প্রকাশে বিলম্ব ঘটতে দেখা গিয়েছিল। আবার নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা পর প্রাপ্ত একটি নাম কাউন্সিলর তালিকায় শুধু যোগই করেননি, তাকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। এরপর নাটকীয়তার দেখা মেলে খসড়া ভোটার তালিকায়। নির্বাচন কমিশন সে তালিকায় রাখেনি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পর্যবেক্ষণে থাকা ১৫টি ক্লাবের কাউন্সিলরদের। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করলে তা ফিরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন। এরপর আবার নাটক। এবার সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদ ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে এ নিয়ে এক রিট করলে দ্বিতীয় দফা আটকে যায় ১৫ ক্লাবের কাউন্সিলরশিপ ও প্রার্থিতা।
এতসব নাটকের মাঝে রচিত হচ্ছিল নতুন নাটকের অঙ্ক। নির্বাচন অংশ নিতে মনোনয়ন তুলেছিলেন ৬১ জন প্রার্থী। যাচাই-বাছাই শেষে ৫১ জনের প্রার্থিতাকে বৈধতা দেয় নির্বাচন কমিশন। তিন ক্যাটাগরিতে ২৩ পরিচালকের বিপরীতে ছিল মোট ৫১ জন প্রার্থী—নির্বাচনী প্রথায় এরপর শুরু হয় সমঝোতা কার্যক্রম। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার উপস্থিতিতে আয়োজিত হয় বেশ কয়েকটি বৈঠক। আমিনুল ইসলাম বুলবুল, ফারুক আহমেদ, তামিম ইকবালদের সেসব বৈঠক একসময় রূপ নেয় দরকষাকাষিতে। গভীর রাতের সেসব বৈঠক থেকে একেক দিন একেক রকম সিদ্ধান্ত আসতে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই সমঝোতায় পৌঁছতে পারেননি ক্রীড়া উপদেষ্টাসহ অন্যরা। সমঝোতার বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর নানা পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম অভিযোগ প্রকাশ পেতে থাকে। এসবের মাঝে তামিম ইকবালের নেতৃত্বে নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপ ও স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন প্রায় ১৬ প্রার্থী। যারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন, তাদের অনেকের নির্বাচনে জয়লাভের সমূহ সম্ভাবনা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
এর পরও সমঝোতার লক্ষ্যে তপশিলের বাইরে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে একটি সুযোগ দেওয়া হয়েছিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারকারীদের। তবে সে সুযোগ নেননি কোনো প্রার্থীই। উল্টো তিন প্রস্তাব নিয়ে সামনে হাজির হন তারা। তাদের দাবি ছিল, বর্তমান বিসিবি পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ বাড়িয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। অথবা অ্যাডহক কমিটির মাধ্যমে নতুন নির্বাচন দেওয়া। প্রয়োজনে বর্তমান তপশিল বাতিল করে নতুন করে ঘোষণার আহ্বানও জানান তারা; কিন্তু এসব দাবিতে সায় দেয়নি ক্রীড়া প্রশাসন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ৪ অক্টোবর ৪৩ ক্লাব সংবাদ সম্মেলন করে ক্রিকেট বর্জনের হুমকি দেয়। পাশাপাশি গতকাল প্রধান উপদেষ্টার কাছে এসব দাবির কথা উল্লেখ করে স্মারকলিপি দেন তারা। যদিও আজকের নির্বাচনের আগে এই আবেদনের কোনো উত্তর পাওয়ার সুযোগ থাকছে না।
সবশেষ নাটকীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছে নির্বাচনের ২০ ঘণ্টা আগে। উচ্চ আদালত থেকে এসেছে নতুন নির্দেশনা। কাউন্সিলরশিপ স্থগিত হওয়া ১৫ ক্লাবের নির্বাচনে অংশ নিতে ও ভোট দিতে যে বাধা ছিল, সেটা তুলে নেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। এতে প্রার্থিতা ফিরে পান বিসিবির বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের ইফতেখার রহমান মিঠুও। শেষ সময় এসে তার প্রার্থিতা ফেরাতে নতুন করে বিপাকে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। ২ অক্টোবর কাউন্সিলদের দেওয়া পোস্টাল বা ই-ভোট ব্যালটগুলোও বাতিল করে নতুন করে নেওয়া হয় ই-ভোট। সব মিলিয়ে নাটকীয়তা আর জটিলতা মধ্য দিয়েই হতে যাচ্ছে এবারের নির্বাচন। আর নির্বাচনের পর বাংলাদেশের ক্রিকেট পাবে নতুন বোর্ড ও নতুন প্রেসিডেন্ট।