
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন সরগরম। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যুত্থান এবং ক্ষমতার পালাবদলের পর দেশ এখন নির্বাচনমুখী।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা জল্পনা ও ষড়যন্ত্রের গুজব থাকলেও, নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে পুরোদমে।
নির্বাচনী মাঠে এখন প্রায় সব রাজনৈতিক দলই প্রস্তুত। যদিও জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতি নিয়ে বড় দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতভেদ রয়েছে, তবুও নির্বাচনী প্রস্তুতিতে কোনো শিথিলতা দেখা যাচ্ছে না। পিআর পদ্ধতির দাবিতে রাজপথে আন্দোলনের কথাও বলছে কয়েকটি দল। ইতোমধ্যেই জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনী আসনগুলোতে প্রার্থিতা বাছাইয়ের কাজ প্রায় শেষ করেছে। সাম্প্রতিক ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়ার পর দলটির আত্মবিশ্বাস আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, খুব শিগগিরই আসনভিত্তিক একক প্রার্থীকে মাঠে নামার জন্য ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া হবে। ফলে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও, বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়—নির্বাচনের ট্রেনে উঠে গেছে সব দলই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মতবিরোধ বা আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও, যদি সব দলের অংশগ্রহণ না থাকে, তবে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই থেকে যাবে বড় প্রশ্ন।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনকে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করার চিঠি পাঠানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও জোরকদমে তাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন জানিয়েছেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নির্বাচনী সামগ্রী কেনাকাটার মতো বড় কাজগুলো ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হওয়ার পথে।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে ১০টি দেশে প্রায় ১৬ হাজার বাংলাদেশি প্রবাসীর ভোটার নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে এবং তাদের এনআইডি স্মার্ট কার্ডও বিতরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ১৪ হাজারের মতো প্রবাসী নাগরিক এনআইডি পেয়েছেন। গত রবিবার (৫ অক্টোবর) নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি
অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ:রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচনের পথ ততটা মসৃণ হবে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। যদিও ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অপসারণ করা হয়েছে এবং প্রশাসনকে দল-নিরপেক্ষভাবে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে, কারণ ডিসিরা নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন।
জাতিসংঘের অধিবেশন শেষ করে প্রধান উপদেষ্টা দেশে ফেরার পর নির্বাচনের জন্য দল-নিরপেক্ষ প্রশাসন সাজানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ শুরু করার কথা ছিল। তিনি ইতোমধ্যেই দেশে ফিরেছেন এবং পূজার পর চারদিনের ছুটি শেষে দাপ্তরিক কার্যক্রমও শুরু করেছেন। এছাড়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণ, অর্থনীতির গতিশীলতা বজায় রাখা, ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যয় থেকে টেনে তোলা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা—এসব বিষয়ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতা:প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর প্রশাসনে গতি এসেছে। ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সরিয়ে দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং কয়েকটি জেলায় জেলা প্রশাসক পরিবর্তন করা হয়েছে। নির্বাচনের সময় প্রশাসনকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ রাখতে ডিসি নিয়োগে ‘ফিটলিস্ট’ প্রস্তুত করা হয়েছে।
অর্থনীতি, ব্যাংকিং সেক্টর ও বাণিজ্যেও নেওয়া হচ্ছে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের উদ্যোগ। অন্তর্বর্তী সরকার চায়, নির্বাচনের সময় যেন বাজার ও ব্যাংক খাতে কোনো বিপর্যয় না ঘটে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বজায় থাকে। তাই নির্বাচনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভারসাম্যও সরকারের প্রধান বিবেচ্য। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নির্বাচন আয়োজনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যেন কোনো ধরনের সহিংসতা বা অনিয়মের ঘটনা না ঘটে। সেনাবাহিনীর প্রস্তুতিও দেশের জনগণের মাঝে একটি আস্থার ও ভরসার পরিবেশ তৈরি করেছে। অতীতে দেখা গেছে, সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকলে ভোটাররা নিরাপদ বোধ করেন এবং নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এবার সশস্ত্র বাহিনী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতো ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ:ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে পূর্ণমাত্রায় কার্যক্রম শুরু করেছে। ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই তফসিল ঘোষণার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করা যায়। নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, সব প্রস্তুতি এখন রোডম্যাপ অনুযায়ী এগোচ্ছে।
প্রথম ধাপে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে, যাতে নতুন ভোটারদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা এবং মৃত ভোটারদের নাম বাদ দেওয়া যায়। পাশাপাশি, নির্বাচনী এলাকার ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্র পুনর্নির্ধারণের কাজ চলছে—বিশেষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের কারণে যেসব এলাকায় নতুন কেন্দ্র প্রয়োজন, সেখানে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও প্রার্থীদের প্রশিক্ষণের কাজও শুরু করেছে। এর পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও চলছে, যাতে ভোটের দিন দায়িত্ব পালনে কোনো ঘাটতি না থাকে।
পুরো প্রক্রিয়ার জন্য কমিশনের মোট বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। কমিশন জানিয়েছে, এটি সুশৃঙ্খল ও ব্যয়সাশ্রয়ীভাবে নির্বাচন আয়োজনের জন্য যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীনও বলেছেন, “আমরা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। রোজা শুরু হওয়ার আগেই ভোট সম্পন্ন করতে চাই। ”
নির্বাচন কমিশনের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে, যাতে সব কার্যক্রম তফসিল ঘোষণার সময়ের আগেই শেষ করা যায়। প্রার্থীদের মনোনয়ন যাচাই, প্রতীক বরাদ্দ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং কেন্দ্র স্থাপন—সব কাজই রোডম্যাপে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে। সব মিলিয়ে কমিশনের লক্ষ্য একটি সময়সীমাবদ্ধ, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং প্রশাসনের ওপর আস্থা বজায় থাকে।
নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি:নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে এখন সমন্বিত প্রস্তুতি চলছে। ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশ, র্যাব ও আনসারসহ প্রায় দেড় লাখ নিরাপত্তা সদস্য মাঠে থাকবে। পাশাপাশি, সেনাবাহিনী থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে, যাতে কোনো এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
এবারের নির্বাচনে প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপারদের (এসপি) নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার জন্য নেওয়া হয়েছে নতুন পদক্ষেপ—লটারির মাধ্যমে পদায়ন। এতে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব বা পক্ষপাতের সুযোগ থাকবে না বলে নির্বাচন কমিশনের আশা।
পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভোটের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্বে থাকবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য ইতিমধ্যে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহরুল আলম বলেছেন, “জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর পুলিশের ভঙ্গুর অবস্থা কাটিয়ে আমরা এখন সক্ষমতায় ফিরেছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজন করা। ”
নির্বাচনের সময় মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয় নিশ্চিত করতে জেলা পর্যায়ে বিশেষ নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এবার সরকারের লক্ষ্য একটাই—যেন নির্বাচনের দিন ভোটাররা ভয়মুক্তভাবে ভোট দিতে পারেন এবং সারাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনের সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, "গত এক বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি দেখতে পেয়েছি, তাতে সন্দেহ আছে কয়েকটা কেন্দ্রেও সহিংসতা ছাড়া নির্বাচন সম্পন্ন করার সক্ষমতা এই অন্তর্বর্তী সরকার রাখে কি না, সারা দেশ তো অনেক দূরের বিষয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এ পর্যন্ত তারা কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পেরেছে? ফেব্রুয়ারিতে তারা নির্বাচন হবে বলছে, কিন্তু ওই নির্বাচন যদি সহিংসতাপূর্ণ হয়, তাতে যদি প্রাণনাশের মতো ঘটনা ঘটে, সেটার দায়ভার নেবে কে?"
রাজনৈতিক সমীকরণ ও নতুন জোটের সম্ভাবনা:ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষকে টেক্কা দেওয়ার কৌশল ঠিক করার কাজ শুরু করেছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। তবে জুলাই সনদ, বিচার এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি বলেও দাবি করছেন অনেকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে।
বিএনপি এবং জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে, যা আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, আওয়ামী লীগের পতনের পর বিএনপি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ পেলে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করবে। কিন্তু কয়েক মাসের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং নানামুখী ঘটনায় নতুন জোটের কারণে পরিস্থিতি আর সরল নেই।
বিএনপি অতীতে জামায়াতকে জোটসঙ্গী করেই ক্ষমতায় এসেছিল, যা তাদের জন্য আশীর্বাদ ও বোঝা উভয়ই ছিল বলে মনে করেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াত দীর্ঘদিনের মিত্র। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এই দুই দল একসঙ্গে সরকারও গঠন করে। তবে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে জামায়াতের প্রতি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়তে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিও কৌশলগতভাবে জামায়াত থেকে দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা করেছে।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন ততই বাড়ছে। একইসাথে দলগুলোর অবস্থান বদলাতে শুরু করেছে। ছোট ও নবীন দলগুলোকে নিজস্ব বলয়ের মধ্যে রাখতে চায় বড় দলগুলো। বিএনপি চায় যুগপৎ শরিকদের পাশাপাশি জামায়াত বাদে ধর্মভিত্তিক অন্য দলগুলোকে সাথে রাখতে। জামায়াত চায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ধরে রাখার পাশাপাশি বিএনপিকে অপছন্দ করা দলগুলোকে কাছে টানতে।
বিএনপি দীর্ঘদিনের যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তি বাড়াতে চায়। এ লক্ষ্যে শরিক দলগুলোর কাছে প্রার্থী তালিকা চেয়ে পাঠিয়েছে এবং শিগগিরই আসন সমঝোতা ও জোট গঠনের বিষয়ে আলোচনায় বসবে। এক কথায়, মিত্রদের নিজ বলয়ের বাইরে যেতে না দিয়ে বরং ডান-বাম ইসলামপন্থি আরও কয়েকটি দল ও সংগঠনকে পাশে রাখতে চায় বিএনপি।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ কয়েকটি দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে, যার বিরোধিতা করছে বিএনপি। তবে জামায়াত ছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফতে মজলিসের দুটি অংশ, নেজামে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)—এই ছয়টি দলকে নিজেদের বলয়ে আনতে কৌশলী পদক্ষেপ নিচ্ছে বিএনপি। ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী সংগঠন হেফাজতে ইসলামকেও কৌশলে পাশে রাখার চেষ্টা চলছে। দলের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্যরা এসব দলের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। বিএনপির বিশ্বাস, এই দলগুলোকে পাশে আনতে পারলে রাজপথে জামায়াতকে মোকাবিলা করা সহজ হবে।
জামায়াত ও বিএনপির বাইরে পৃথকভাবে নতুন রাজনৈতিক জোট গড়ার পরিকল্পনা করছে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জামায়াতে ইসলামী এখন পর্যন্ত এনসিপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় সমর্থন ও অংশগ্রহণ করে আসছে। রাষ্ট্রপতির অপসারণ, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণসহ নানা কর্মসূচিতে জামায়াত তাদের সঙ্গে ছিল। এমনকি এনসিপির নতুন সংবিধান ও ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’-এর দাবিতেও জামায়াত সমর্থন জানিয়েছে, যদিও এসব বিষয়ে বিএনপি ভিন্ন অবস্থান নেয়।
তবে দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, জামায়াতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও সম্প্রতি তাদের জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নিম্নকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির দাবিতে দূরত্ব বজায় রাখবে এনসিপি। গত ১৮ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে এনসিপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) ও গণ অধিকার পরিষদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে জুলাই সনদ ও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি দল পিআরসহ পাঁচ দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। প্রথমে এই কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও পরে এনসিপি সরে আসে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোও একটি বৃহৎ নির্বাচনী জোট করার পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে বামপন্থি দলগুলোর যেসব জোট রয়েছে, সেগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চলছে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বামপন্থি দল ও জোটের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা চলছে। জানা গেছে, চলতি অক্টোবরের মধ্যেই নতুন একটি জোট আত্মপ্রকাশ করতে পারে। এই জোটে বামপন্থি দল ছাড়াও প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক দলগুলোকে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটার পর বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের টানাপোড়েন তীব্র আকার ধারণ করে। বিশেষ করে ‘সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে’—এই প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে স্পষ্ট বিভক্তি তৈরি হয়। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিতে চাচ্ছে, অন্যদিকে জামায়াত পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলে এ অবস্থানগত বিভাজন সম্পর্কের টানাপোড়েনকে আরও গভীর করেছে।
যদি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তবে তাদের ভোট স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিএনপির ঘরে যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। মাঠপর্যায়ে কিছু কার্যক্রমে বিএনপির ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা সুইং ভোটারদের মধ্যে অনাগ্রহ তৈরি করতে পারে। এ অবস্থায় বিরোধী পক্ষগুলোর মধ্যে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যেখানে জামায়াত একটি প্রধান স্টেকহোল্ডার হয়ে উঠতে পারে।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক ও যশোর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ফকির শওকত বাংলানিউজকে বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের এখন কাজ হচ্ছে একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়া। ভোট দেওয়ার মাধ্যমেই জনগণ নিজেদের পছন্দ-অপন্দের জবাব দেবে। পিআর পদ্ধতিতে কি জনগণ নির্বাচন চেয়েছে? জনগণের উপর চাপিয়ে দিলেই তো হবে না। আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টিকে তারা চায় কি না, ভোটের মাধ্যমেই জবাব দেক। "
চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা:প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আশা মতে, আসন্ন নির্বাচন শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই গণতন্ত্রের এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে। তবে তিনি এটিও স্বীকার করেছেন যে, এখনো রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করা এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে জামায়াতসহ কয়েকটি দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে, যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, সংবিধানের বাইরে গিয়ে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন আয়োজন করবে না, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে আরও উত্তেজনা তৈরি করেছে।
সম্প্রতি নিউইয়র্কে মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ড. ইউনূস বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কিছু প্রভাবশালী মহল নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তার দাবি, নির্বাচন ঠেকাতে একদল শক্তি সংগঠিতভাবে কাজ করছে এবং এর পেছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বাংলাদেশে এসে পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন, যেন যেসব বিষয় আড়ালে আছে তা স্পষ্টভাবে সামনে আসে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ড. ইউনূসের মার্কিন ঘনিষ্ঠতা এবং নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে তার দৃঢ় অবস্থানই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে, তিনি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন শেষ করবেন। পিআর পদ্ধতি কিংবা নির্বাচন পেছানোর পরামর্শ যেই দিক না কেন, তিনি সম্ভবত তা আর আমলে নেবেন না। তার এই অটল অবস্থান নির্বাচন সময়মতো সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে এক অনুঘটকের ভূমিকা রাখছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্বাচনের ট্রেন ইতোমধ্যেই ছেড়ে দিয়েছে স্টেশন। কে উঠবে, কে নামবে, তা এখন সময়ই বলে দেবে। কিন্তু যেভাবে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রস্তুতি এগোচ্ছে, তাতে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজন এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের জনগণ চায় শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ একটি নির্বাচন। তাদের বিশ্বাস, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দীর্ঘ অধ্যায় পেরিয়ে এবার হয়তো নির্বাচনের সেই ট্রেনে চড়েই গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় দেখবে বাংলাদেশ।