Image description

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে সহিংসতার ইতিহাস বেশ পুরোনো। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসবের লক্ষ্য থাকে সেনাসদস্য ও বাঙালিরা। সংকট নিরসনে ১৯৯৭ সালে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে সরকার। কিন্তু এরপরও সহিংসতা থামেনি। ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত অঞ্চলটিতে প্রায় ৪০০ সেনাসদস্য এবং ৩০ হাজার বাঙালি হত্যার শিকার হয়েছেন। অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে ভারতপন্থি তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও বামপন্থিরা নীরবতা পালন করে আসছেন। শুধু তাই নয়; তারা পার্বত্যাঞ্চলে সন্ত্রাসকে উসকে দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের মতে, পার্বত্যাঞ্চলে বাঙালিদের ওপর সংঘটিত গণহত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, অপহরণ ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশের ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবী সমাজ কখনোই নিন্দা জানায় না। এমনকি তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিচারও দাবি করে না। তাদের এ নীরবতা পার্বত্যাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।

তারা আরো বলছেন, সর্বশেষ ভারতের মদতপুষ্ট ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সাজানো ধর্ষণের নাটক এবং পরে বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন লাগানো, সেনাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনায় তথাকথিত ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা ছিলেন একেবারেই চুপ। অন্যদিকে, এসব বুদ্ধিজীবী পার্বত্যাঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে সমর্থন জানাতে ভুলছেন না। তারা ‘পাহাড় থেকে সেনা হটাও’ স্লোগানকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার পেছনে ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবীদের উসকানি রয়েছে জানিয়ে সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. শাহীদুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, এসব বুদ্ধিজীবীর এক পা ভারতে রাখা। যখন পাহাড়ে সন্ত্রাসীরা হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করছে, তখন দেশের এসব বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকারকর্মীর নীরবতা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও বিশ্বাসের জন্য বড় ধরনের হুমকি সৃষ্টি করছে। এরা মূলত ভিনদেশের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। এমনকি পাহাড়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদা নেওয়ার ভাগও তাদের কাছে চলে যায়।

রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক বলেন, খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সহিংসতার নেপথ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক তৎপরতা। কথিত ধর্ষণসংক্রান্ত অভিযোগকে বড় করে তোলার সূত্র ধরে সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলো স্থানীয়দের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে এবং সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে।

কর্নেল হকের দাবি, ইউপিডিএফের এ কার্যক্রমের পেছনে রয়েছে সীমান্তপারের কিছু শক্তির ইন্ধন ও সহায়তা। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পার্বত্যাঞ্চলে চাঁদাবাজি, জোরপূর্বক সম্পত্তি দখল এবং অপহরণসহ বিভিন্ন অবৈধ কাজে জড়িত। এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকায় পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা বিপন্ন হচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চলের অস্থিতিশীলতা কৌশলে বৃদ্ধি করে দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক সংকট তৈরির চেষ্টা চলছে।

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার দাবি, ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ৪০০ সেনাসদস্যকে হত্যা করেছে।

পার্বত্যাঞ্চলে আক্রান্ত বাঙালিরা, চুপ সুশীলসমাজ

খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের নাটকের ঘটনায় পাহাড়ি ও বাঙালি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় বাঙালিদের শতাধিক বাড়িঘরে আগুন দেয় পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। পাহাড়িদের ঘরবাড়িও আক্রান্ত হয়। সংঘর্ষে একজন মেজরসহ ১৬ সেনাসদস্য আহত হন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত আটদিন ধরে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থিরা বিবৃতি দিচ্ছেন এবং মানববন্ধন করছেন। এসব কর্মসূচিতে আক্রান্ত বাঙালি বা সেনাসদস্যদের বিষয় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হচ্ছে। উল্লেখ করা হচ্ছে না সশস্ত্র গ্রুপ ইউপিডিএফের নাম।

খাগড়াছড়িতে ‘পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের’ দাবিতে রাজধানীতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ করে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা। সেখানে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি।

গত ১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগে মানববন্ধন করে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজের বক্তব্যে একবারও পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বিচার বা বাঙালিদের বাড়িঘরে হামলা, এমনকি সেনাসদস্যদের ওপর হামলার বিষয়ে উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি। উল্টো পাহাড়িদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিচার চান তিনি। বিচার চান সেনাসদস্যদেরও, যারা সহিংসতা ঠেকাতে জীবনবাজি রেখে লড়েছেন।

খাগড়াছড়িতে ‘কিশোরীকে ধর্ষণ’ এবং পরে অবরোধ চলাকালে গুলিতে পাহাড়ি নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে গত ১ অক্টোবর বিবৃতি দেন দেশের ৩৬ বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে সই করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবিরের মতো বুদ্ধিজীবীরা। ওই বিবৃতিতে পাহাড়ে বাস করা বাঙালি এবং আহত সেনাসদস্যদের বিষয়ে কোনো কথা উল্লেখ নেই। একই ভাবে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশের (এইচআরএফবি) বিবৃতিতেও পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে কোনো বক্তব্য ছিল না।

সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. শাহীদুজ্জামান বলেন, এরা সবাই বাংলাদেশের শত্রু। তারা ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ভারতপন্থি এসব বুদ্ধিজীবী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন, বিভিন্ন এনজিও থেকে টাকা পান। এদের বিচার আগে করা উচিত।

পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে ৪০০ সেনা ও ৩০ হাজার বাঙালি নিহত

পুলিশ ও সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ৩০ হাজার বাঙালি হত্যার শিকার হয়েছেন, যার একটিরও বিচার হয়নি। একই সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে ৪০০ সেনাসদস্যকেও।

স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাঙালিদের বিরুদ্ধে চালানো উল্লেখযোগ্য গণহত্যার মধ্যে রয়েছেÑ১৯৮৪ সালের ৩০ মে রাঙামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়ায় ৪৩৭ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা, ১৯৮৬ সালের ২২ ডিসেম্বর রামগড়ে ৩৩ জনকে হত্যা এবং শতাধিক বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, ১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর লংগদুর পাকুয়াখালীতে ৩৫ জন নিরীহ বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা। একই ভাবে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত মাটিরাঙ্গা, রামগড়, বান্দরবান ও পানছড়ি এলাকায় শান্তিবাহিনী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়।

এসব সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি করে সরকার। কিন্তু এরপরও পার্বত্যাঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সন্ত্রাস থামছে না। যেমন ২০০৩ সালে মহালছড়িতে সহিংসতায় ৭০০’র বেশি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষে শতাধিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত এবং বেশ কয়েকজন নিহত হন। ২০১১ সালের ২১ মে রাঙামাটির মিদিঙাছড়িতে ইউপিডিএফের নেতাকর্মীদের ওপর জেএসএস (সন্তু লারমা) নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে চারজনকে হত্যা করে।

পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় প্রায় ১৪ লাখ মানুষ বাস করে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ বাঙালি এবং ৪১ শতাংশ পাহাড়ি।

স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দারা জানান, হাজার হাজার নিরীহ মানুষের হত্যার বিচারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উল্টো সন্তু লারমার মতো যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, তাদের ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এটি স্বাধীন দেশের জন্য লজ্জার বিষয়।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, দেশের বিভিন্ন ঘটনায় মুসলিম ও বাঙালিরা আক্রান্ত হলেও পশ্চিমা ও ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থি মহল কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তারা পাহাড়ে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড, অপহরণ এবং গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী ঘটনায় কোনোদিন স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি।

তিনি আরো বলেন, অসাম্প্রদায়িক এবং মানবাধিকারের মুখোশ পরে এই মহল পাহাড়ের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে। এসব ঘটনায় তাদের নীরবতার কারণে জনগণ বিভ্রান্ত এবং প্রতিরোধহীন হয়েছে। যেখানে দেশের সেনাসদস্য এবং সাধারণ বাঙালিরা নিহত হয়েছেন, সেখানে তারা কোনো প্রতিবাদ বা বিচার দাবিতে মুখ খোলেনি। উল্টো কিছু মহল সন্ত্রাসীদের পক্ষ নেওয়ার মতো বক্তব্য দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। এই দ্বৈত চরিত্রই দেশের ক্ষতি করছে।

তিনি সতর্ক করে বলেন, দেশের গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবী মহল যদি এই নীরবতা অব্যাহত রাখে, তবে তা শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও নিরাপত্তাকে নয়; সমগ্র জাতির নৈতিক স্থিতি ও আইনশৃঙ্খলাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এজন্য সরকারের উচিত দ্রুত পাহাড়ে সেনা অভিযান চালানোর পাশাপাশি ক্যাম্প বাড়ানো।