
ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ হাজার ৪২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে এক দিনে মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল রবিবার ডেঙ্গু বিষয়ক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, চলতি বছর ৪৯ হাজার ৯০৭ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১২ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হওয়া ৯ জনের মধ্যে চার জনের মৃত্যু হয়েছে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুই জন, ডিএনসিসি কোভিড-১৯ হাসপাতালে এক জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে এক জন এবং কক্সবাজার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে এক জন মারা গেছেন। মৃতদের মধ্যে চার জন পুরুষ, পাঁচ জন নারী। তাদের বয়স ১৭ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সবচেয়ে বেশি ভর্তি হয়েছেন, ৩২২ জন। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ১৯৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০৪ জন, খুলনা বিভাগে ৭২ জন, রাজশাহী বিভাগে ৮২ জন, রংপুর বিভাগে ২৩ জন, বরিশাল বিভাগে ১৯৫ জন এবং সিলেট বিভাগে পাঁচ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিত্সাধীন আছেন ২ হাজার ৪৩৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৭৮৭ জন, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ১ হাজার ৬৫২ জন চিকিত্সা নিচ্ছেন।
বছরের এই সময়টাতে সাধারণত ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। গত বছরেও এ সময়ে বেড়েছিল। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর ৯ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুই-ই বেশি। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী শনাক্তে পর্যাপ্ত কিট রয়েছে। কিন্তু তার পরও অধিকাংশ রোগী হাসপাতালে আসছে দেরিতে এবং ভর্তি হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই মারা যাচ্ছে। আর তরুণদেরই মৃত্যু হচ্ছে বেশি। হাসপাতালে রোগীরা আসছে জ্বর শুরু হওয়ার ছয় থেকে সাত দিন পরে। ফলে রোগীর জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
এছাড়া শিশুদের মধ্যেও মৃত্যুঝুঁকি বেড়েছে। ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি মোকাবিলায় সময়মতো চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ডেঙ্গু রোগী মারা যাচ্ছে শক সিনড্রোমে। রোগীর শরীর থেকে পানি বেড়িয়ে গিয়ে প্রশ্রাবের পরিমাণ কমে যায়। পেটে পানি জমে, ফুসফুসে পানি জমে, রোগীর বোধশক্তি কমে যায়। অনেক রোগী হাসপাতালে আসছে গুরুতর পেট ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, তীব্র অবসাদ, প্রশ্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়ার মতো লক্ষণ নিয়ে।
দেশের ১০ জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি :চলতি বছর ১০ জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ রোগী বরগুনা জেলায়। এর পরই রয়েছে ঢাকা, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, গাজীপুর ও কুমিল্লা।
চলতি বছর আক্রান্ত :এ বছর ডেঙ্গু নিয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হন সেপ্টেম্বরে, গেল মাসে ১৫ হাজার ৮৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, আর অক্টোবরের পাঁচ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হলেন ২ হাজার ৫৬৫ জন, এর আগে জুলাই মাসে ১০ হাজার ৬৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এছাড়া জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন, জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন রোগী ভর্তি হন।
চলতি বছর মৃত্যু :চলতি বছর সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। আর অক্টোবরের পাঁচ দিনে মৃত্যু হলো ১৪ জনের। এরপরে জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৪১ জনের মৃত্যু হয়। তার আগে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিন জন, এপ্রিলে সাত জন, মে মাসে তিন জন, জুনে ১৯ জন ও আগস্টে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়। মার্চ মাসে কারো মৃত্যুর তথ্য দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন ইত্তেফাককে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। মশার প্রজনন কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করতে হবে। আর জ্বর এলে চিকিত্সকের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, মশা নিধনের কাজ স্বাস্থ্য অধিপ্তরের নয়, এটা সিটি করপোরেশনের কাজ। এ কাজের সমন্বয় অতি জরুরি, কিন্তু তা করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা যত ব্যবস্থাই নেই না কেনো, জনগণ সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা দূষ্কর।