
জাতীয় চিড়িয়াখানার আধুনিকায়ন যেন কাগজের ভেতরেই আটকে আছে। চার বছর আগে বহুল আলোচিত মাস্টারপ্ল্যানের কাজ শেষ হয়েছে। পেয়েছে অনুমোদনও। কিন্তু বাস্তবায়নের কাজ এখনো শুরু হয়নি।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন প্রায় এক হাজার ২২৭ কোটি টাকা। তবে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের প্রকল্প এত দিনেও অনুমোদন পায়নি। ফলে প্রাণী ও দর্শনার্থীদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ থেমে আছে। ঢাকার এই চিড়িয়াখানার পাশাপাশি রংপুরের চিড়িয়াখানার আধুনিকায়নের পরিকল্পনাও একই সঙ্গেই নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন হলে ঢাকা চিড়িয়াখানা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হবে। এখানে তৈরি হবে প্রাণীদের জন্য আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র, গবেষণাগার, উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক মানের প্রদর্শনী এলাকা। দর্শনার্থীরাও পাবে বিশ্বমানের বিনোদন এবং শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা।
নতুন মাস্টারপ্ল্যানের নকশায় চিড়িয়াখানাকে সাজানো হবে পাঁচটি স্বতন্ত্র জোনে, প্রতিটি জোনে প্রাণীরা নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামো উন্নয়ন ও পরিবেশগত সংস্কার হয়নি। ফলে প্রাণীগুলো যেমন কষ্টে আছে, তেমনি পর্যটকরাও পাচ্ছে না আকর্ষণীয় পরিবেশ। বর্তমানে প্রাণীগুলো এমনভাবে সাজানো রয়েছে যে সব প্রাণী ঘুরে দেখা সম্ভব নয়।
জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ড. মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদিত হয়েছে।
চিড়িয়াখানার কিউরেটর ড. আতিকুর রহমান বলেন, বছরে ৩২ থেকে ৪০ লাখ দর্শনার্থী এখানে আসে। তাদের বিনোদনের পাশাপাশি প্রাণীদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখার জন্য মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন জরুরি। বিষয়টি বিবেচনায় এনেই পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। তিনি জানান, বাঘের সুস্বাস্থ্যের জন্য হাঁটা খুবই জরুরি। বছরে ২০ কিলোমিটারও হাঁটতে পারছে না এরা। নতুন পরিকল্পনায় প্রাণীরা এই সুবিধা পাবে। এভাবে প্রতিটি প্রাণীর জন্য আলাদা আলাদা প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করা হবে।
২০১৮ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় হাতে নেয় মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ। প্রায় ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস এবং একটি দেশীয় পরামর্শক সংস্থার সহায়তায় শুরু হয় ঢাকা ও রংপুর চিড়িয়াখানার জন্য আধুনিক মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুলাইয়ে। কিন্তু এটি পরের বছর ২০২১ সালে অনুমোদন পায়।
যা আছে মাস্টারপ্ল্যানে : এই মহাপরিকল্পনা অনুসারে, সম্পূর্ণ চিড়িয়াখানার চারদিক থেকে সীমানাপ্রাচীর দেওয়াসহ হবে নানা ধরনের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। চিড়িয়াখানার মধ্যেই স্থান পাবে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। জলাভূমির মাঝে মাঝে থাকবে বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল।
বর্তমান চিড়িয়াখানার সব খাঁচাই বদলে ফেলা হবে। বদলে যাবে পুরো কাঠামো। প্রাণীদের বসবাসের পরিবেশ নতুনভাবে তৈরি করা হবে। থাকবে কৃত্রিমভাবে তৈরি পাহাড় ও ঝরনা। চারপাশেই থাকবে লেক।
মাস্টারপ্ল্যানে বলা হয়েছে, প্রায় ৭৭ হেক্টর এলাকাজুড়ে সাজানো হবে বৈচিত্র্যময় প্রাণীর আবাসভূমি। এখানে জায়গা পাবে মোট ২২৩ প্রজাতির প্রাণী, যার মধ্যে দেশীয় প্রজাতি ১০২টি, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ৬৬টি, আফ্রিকার ৪০টি এবং নিশাচর প্রাণী থাকবে ১৫ প্রজাতির। শিশুদের বিনোদন ও শিক্ষার জন্য পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে বিশেষ অ্যাকটিভ জোন, যেখানে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে আরো ১০ প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে।
শিশুদের বিনোদন, অ্যাডভেঞ্চার ও শিক্ষামূলক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকবে পাঁচ হেক্টরেরও বেশি এলাকাজুড়ে। সাড়ে সাত কিলোমিটারজুড়ে থাকবে পাঁচটি হাঁটার পথ। দুটি ট্রাম রুট থাকবে। নৌকা চলাচলের জন্যও দুটি রুট থাকবে। থাকবে লেকের ওপর ভাসমান একটি রেস্তোরাঁ।
জোনগুলোর একটি হবে বাংলাদেশের প্রাণীদের আবাসস্থলের আদলে, একটি হবে আফ্রিকার প্রাণীদের জন্য। এ ছাড়া নিশাচর ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের প্রাণীর আবাস অনুসারে আলাদা দুটি জোন হবে।
থাকবে ২৬ প্রজাতির মাছ, ৯ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৪ প্রজাতির পাখি এবং ১২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। ট্রপিক্যাল হ্যাবিটেট জোনে হবে ৬৬ প্রজাতির প্রাণীর জন্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন। আফ্রিকান হ্যাবিটেট জোনে মহাদেশটির পরিবেশে বিচরণকারী প্রাণীদের রাখা হবে। নিশাচর প্রাণীর হ্যাবিটেট জোন ঘন জঙ্গলের আদলে গড়ে তোলা হবে।
পরিদর্শনের জন্য থাকবে গাইড। দর্শনার্থীদের প্রতিটি প্রাণী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া বা চিড়িয়াখানাটি ঘুরে দেখানোর জন্য তারা সহায়তা করবে। এ ছাড়া বাড়বে জনবলও।