Image description
কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন ১৫টি সৈকত, প্রকৃতি যেন তার সবটুকু দিয়ে সাজিয়েছে দক্ষিণ উপকূল

প্রকৃতি যেন তার সবটুকু দিয়ে সাজিয়েছে দক্ষিণ উপকূল। যদিও এর মধ্যে শুধু কুয়াকাটাকেই চেনে সবাই। কিন্তু এই কুয়াকাটা ছাড়াও বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনায় রয়েছে আরও চৌদ্দটি সমুদ্রসৈকত। যার কয়েকটির সঙ্গে আছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর কয়েকটি নদীর মোহনা। এতগুলো সৈকতই শুধু নয়, কুয়াকাটা ঘুরতে আসা পর্যটক চাইলেই দেখে আসতে পারেন সুন্দরবন।

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু দক্ষিণ উপকূল ঘিরেই রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। যে সম্ভাবনা কাজে লাগানো গেলে ঘুরে যাবে বরিশাল তথা পুরো দেশের অর্থনীতির চাকা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব সৈকত নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা নেই সরকারের। পর্যটকরা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে এসব জায়গায় গেলেও পর্যটক আকর্ষণের জন্য আজ পর্যন্ত কিছুই করেনি পর্যটন মন্ত্রণালয়। বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কাওসার বলেন, ‘কুয়াকাটা ও তার আশপাশের কয়েকটি সৈকত নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের সমন্বিত একটি উদ্যোগ রয়েছে আমাদের। তবে পুরো দক্ষিণ উপকূলের পর্যটন নিয়ে ভাবতে গেলে বড় ধরনের পরিকল্পনা প্রয়োজন।’

বরিশাল অঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে এখনো কুয়াকাটাকেই চেনে মানুষ। একই সৈকতে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয় দেখার অনন্য বৈশিষ্ট থাকায় যার পরিচিতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশে। তবে শুধু কুয়াকাটা নয়, এর দুপাশে রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ আরও অন্তত ১৪টি সমুদ্রসৈকত। যার অধিকাংশের খবর জানে না কেউ। এর মধ্যে কয়েকটি সৈকতে কিছু পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও বাকিগুলো পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। এই সৈকতগুলো শুধু নয়, চাইলে কুয়াকাটা থেকে দিনে দিনে ঘুরে আসা যায় বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। শুধু উদ্যোগের অভাবে যা আটকে আছে আজও।

সম্প্রতি পর্যটকদের দৃষ্টি পড়েছে ৩ নদীর মোহনায় থাকা নিদ্রার চর সমুদ্রসৈকতের দিকে। চট্টগ্রামের গুলিয়াখালির মতো অসংখ্য ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা এই সৈকতের অবস্থান বরগুনার তালতলী উপজেলায়। সড়কপথে তালতলী হয়ে যেতে হয় সেখানে। কুয়াকাটা থেকে সমুদ্র পথে আসা যায় স্পিডবোট কিংবা ট্রলারে। ইদানীং বিপুলসংখ্যক পর্যটক ভিড় জমাচ্ছেন নিদ্রা সৈকতে। তবে এখানে নেই থাকার কোনো ব্যবস্থা। উপজেলা শহর তালতলীতে আবাসিক হোটেলে থাকেন পর্যটকরা। জেলা পরিষদের একটি গেস্ট হাউজ থাকলেও বছরের পর বছর তা দখল করে আছেন সরকারি কর্মকর্তারা। উপজেলা পরিষদের গেস্ট হাউজে আবার নেই যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

তালতলী উপজেলায় রয়েছে আরও দুটি সমুদ্রসৈকত। সংরক্ষিত বনাঞ্চল টেংরাগিরি ঘেঁষে থাকা সমুদ্র তীর আর উপজেলা শহরের পাশেই থাকা শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত। টেংরাগিরি বনের ভেতর দিয়ে হাঁটা ৩ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় সৈকতে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সরু পথ পেরোনোর সময় চোখে পড়বে হরিণ আর বানরের দল। খাঁচায় ঘেরা পুকুরে রয়েছে কুমির। শুভসন্ধ্যা সৈকতে দাঁড়ালে দেখা যায় ৩ নদীর মোহনা আর দূরে আবছা সুন্দরবন। স্থানীয়রা যাকে বলে মাথাল। কুয়াকাটা ভ্রমণে এসে ট্রলার কিংবা স্পিডবোটে যাওয়া যাবে টেংরাগিরি-শুভসন্ধ্যা সৈকতে।

বরগুনার পাথরঘাটায় রয়েছে হরিনঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর জঙ্গল ঘেঁষে সমুদ্রসৈকত। এই পর্যটন কেন্দ্র ঘিরে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল সেখানকার জেলা প্রশাসন। তবে সেসব কাজের কোনোটাই পায়নি পূর্ণাঙ্গ রূপ। মাঝপথে থেমে গেছে ওয়াকিং ট্রেইল নির্মাণের কাজ। জঙ্গলের ভেতরে নির্মাণ করা ওয়াচ টাওয়ারের করুণ দশা। এখানে নির্মিত দুটি গেস্ট হাউজও হয়ে পড়েছে বসবাসের অনুপযোগী। পর্যটন নিয়ে কাজ করা বরগুনার পরিচিত মুখ আরিফুর রহমান বলেন, ‘বরগুনা হতে পারে পর্যটনের নতুন গন্তব্য। জঙ্গল-সমুদ্র-নদীর মোহনা, সবই আছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে থমকে আছে সব। তারপরও বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসেন এসব এলাকা ভ্রমণে। আমরাও চেষ্টা করি তাদের বেড়ানোর আনন্দ দিতে।’

পটুয়াখালী জেলায় কুয়াকাটা ছাড়াও রয়েছে ৪টি অনিন্দ্য সুন্দর সমুদ্রসৈকত। এগুলোর অবস্থান রাঙ্গাবালী উপজেলায়। নৌপথে রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি যাওয়া যায় রাঙ্গাবালী। সড়ক পথে যেতে হয় বরিশাল-পটুয়াখালী হয়ে। সাগরপাড়ের বালিয়াড়ীতে পড়া সূর্যের আলো সোনার মতো চিকচিক করে বলে নাম ‘সোনার চর’ কিংবা অসংখ্য পাখির কলতানে মুখর ‘চর হেয়ার’ এর মতো এখানে থাকা ৪টি সৈকতেরই রয়েছে সৌন্দর্যের আলাদা বৈশিষ্ট্য। চর তুফানিয়া সৈকতে দেখা মিলবে লাল কাঁকড়ায় ঢেকে থাকা সমুদ্র তীর। জাহাজমারা সৈকতে ভিড় জমায় নানা রংয়ের বিচিত্র মাছের ঝাঁক। রাঙ্গাবালী থেকে যাতায়াতে খানিকটা ঝক্কি হলেও কুয়াকাটা থেকে খুব সহজেই ট্যুরিস্ট বোট, ট্রলার কিংবা স্পিডবোটে যাওয়া যায় এসব সৈকতে। তবে আবাসনের ব্যবস্থা নেই কোনোটিতেই। রাঙ্গাবালী শহরের হোটেলে থাকতে হয় পর্যটকদের। স্থানীয় সংবাদকর্মী কামরুল হাসান জানান, ‘পর্যটনের তেমন সুবিধা না থাকলেও শুধু প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখতে এসব সৈকতে ছুটে আসেন বিপুলসংখ্যক পর্যটক। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা।’

ভোলার চরফ্যাশনে রয়েছে ৩টি সমুদ্রসৈকত। উপজেলার চর ফকিরা ইউনিয়নের খাজুরগাছিয়া, কুকরি মুকরি ইউনিয়নের নারিকেল বাগান ও ঢালচরের তারুয়া সৈকত। উপজেলা শহর থেকে সরাসরি যাওয়া যায় খাজুরগাছিয়া সৈকতে। সড়ক পথে নিজস্ব কিংবা ভাড়া করা বাহনে যেতে হয় সেখানে। নারিকেল বাগান কিংবা তাড়ুয়া যেতে প্রথমে যেতে হবে কচ্ছপিয়া বাজার। সেখান থেকে ট্রলার কিংবা স্পিডবোটে পৌঁছানো যাবে এই দুই সৈকতে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে থাকার খুব একটা ভালো ব্যবস্থা না থাকলেও কাছেই উপজেলা শহর হওয়ায় দুর্ভোগে পড়তে হয় না পর্যটকদের। উপজেলা শহরে থাকা জ্যাকব টাওয়ার কিংবা চিন্তার দ্বীপ মনপুরা উপজেলার সৌন্দর্য দেখতেও চরফ্যাশনে আসেন বিপুলসংখ্যক পর্যটক।

এছাড়া কুয়াকাটার কাছাকাছি থাকা গঙ্গামতি, লেম্বুর চর আর চরবিজয় সমুদ্রসৈকত অবশ্য বেশ পরিচিত পর্যটকদের কাছে। কুয়াকাটায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের প্রায় সবাই সাগরপাড় ধরে মোটর বাইক কিংবা থ্রি হুইলারে চেপে বেড়াতে যান এসব সৈকতে। চরবিজয়ের অবস্থান কুয়াকাটা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে। বর্ষা থেকে শীতকালের আগ পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে থাকে চর বিজয়। শীতের শুরুতে মাথা তোলে নোনা জল ছাড়িয়ে। তখন পুরো চরে রাজত্ব করে লাল কাঁকড়া। এখানে থাকার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় দিনে দিনে গিয়ে ফিরে আসতে হয়। কুয়াকাটা থেকে চরবিজয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় ট্রলার কিংবা স্পিডবোট।

কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘এসব সমুদ্রসৈকত আর সংরক্ষিত বনাঞ্চলে খুব সহজে যাওয়া যায় কুয়াকাটা থেকে। কুয়াকাটাকে হাব হিসাবে ধরে এসব সৈকত ঘিরে পর্যটনের একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া গেলে শুধু দেশ নয়, সারা বিশ্বের অন্যতম একটি পর্যটন গন্তব্য হবে দক্ষিণ উপকূল। তাছাড়া এই কুয়াকাটা থেকে দিনে দিনে গিয়ে ঘুরে আসা যায় সুন্দরবন। একটি প্রাইভেট কোম্পানি পরীক্ষামূলকভাবে উদ্যোগটি নিয়ে জাহাজও চালিয়েছিল। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মাত্র ১৫-২০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৪-১৫টি সমুদ্রসৈকত, সংরক্ষিত বনাঞ্চল আর সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। এটি নিয়ে আমরা বহুবার বলেছি। কেউ কানে তোলেনি। অথচ এই একটি উদ্যোগ পুরো দেশের পর্যটন চিত্র পালটে দিতে পারে।’

বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার রায়হান কাওসার বলেন, ‘কুয়াকাটা থেকে বরগুনার হরিনঘাটা পর্যন্ত পর্যটকবাহী জাহাজ চালানোর একটা উদ্যোগ নিয়েছি। নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ চলছে। বিআইডব্লিউটিসির বেশ কয়েকটি প্যাডেল স্টিমার অলস বসে আছে। আমরা চাইছি তার কোনো একটি রেডি করতে। প্রাইভেট কোনো কোম্পানি যদি এটি লিজ নিয়ে ডে ট্রিপের ব্যবস্থা করে তাহলে বিপুলসংখ্যক পর্যটক কুয়াকাটা থেকে সমুদ্র ভ্রমণে যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে নদীর কিছু অংশ ড্রেজিং করতে হবে। আমরা এটি নিয়েও কাজ করছি। পরিকল্পনাটি সফল হলে কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত জাহাজ ভ্রমণের পথ অনেকটাই সহজ হবে। পরে সেই বিষয়টি নিয়েও কাজ করব আমরা।’