
দেশে শিক্ষার মান ক্রমে নিচের দিকে নামছে। শিক্ষার্থীদের পাঠদক্ষতা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও বাস্তব প্রয়োগ ক্ষমতায় বড় ধরনের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গনে বাংলাদেশের ডিগ্রির মান অবনমনেরও খবর আসছে।
বিশ্বব্যাংকের চলতি বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়ে বলা হয়, একটি শিশু ১৮ বছর বয়সে সাধারণত ১১ বছর মেয়াদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন্ন করে (প্রথম শ্রেণি থেকে একাদশ শ্রেণি)।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাঠ্যবই ঠিকভাবে পড়তে পারে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ২০২২ সালে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, শিক্ষার গুণগত মান কমে যাওয়া দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত ও নাইজেরিয়া এবং বেড়েছে পেরু, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের। এর মধ্যে ভিয়েতনামের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ ভিয়েতনামের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষক সংকট, প্রশিক্ষণের ঘাটতি, মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন না করা, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে শিক্ষার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ও দক্ষতাভিত্তিক পাঠদান প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকায় শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষার মানের দিক দিয়ে আমরা খুব একটা এগোতে পারছি না। তবে সেটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো নয়। আমাদের ছেলেমেয়েরা বুদ্ধিমান। এত দিন আমাদের শিক্ষক নিয়োগের মান ভালো ছিল না। ফান্ডের সংকটে গবেষণা পিছিয়ে আছে। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হয়, তা খুবই কম। ফলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসছে না। তাই শিক্ষার মান বাড়াতে এই খাতের বাজেটও অনেক বাড়ানো উচিত।’
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মোট বিশ্ববিদ্যালয় ১৭২টি। এর মধ্যে সরকারি ৫৬টি আর বেসরকারি ১১৬টি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) প্রকাশিত ২০২৫ সালের বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং অনুযায়ী, বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানই স্থান পায়নি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং ২০২৫’-এ সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই।
২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলেও শিক্ষার মানের একটা চিত্র বেরিয়ে আসে। ওই শিক্ষাবর্ষে বিজ্ঞান ইউনিটে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৯৪ শতাংশ অকৃতকার্য। কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটেও ৯০ শতাংশের বেশি ভর্তীচ্ছু ফেল করেছেন। এই দুই ইউনিটের পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া এক লাখ ২১ হাজার শিক্ষার্থী পাস করতে পারেননি।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের ২০২২ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে তৃতীয় শেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ বাংলায় ও ৩৯ শতাংশ গণিতে শ্রেণি বিবেচনায় প্রত্যাশিত দক্ষতা অর্জন করেছে। পঞ্চম শ্রেণির ক্ষেত্রে বাংলায় এ হার ৫০ ও গণিতে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাতৃভাষা বাংলায়ই অর্ধেক শিক্ষার্থী দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন বিভাগের সর্বশেষ ২০২৩ সালের প্রতিবেদনেও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার চিত্র উঠে আসে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের অবস্থা খারাপ। অষ্টম শ্রেণিতে ইংরেজিতে ২৮ শতাংশ মোটামুটি ভালো, অন্যরা নানা স্তরে রয়েছে। ওই শ্রেণিতে গণিতে ৩৬ শতাংশ মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একজন স্নাতকের সনদকে সিঙ্গাপুরে ফাউন্ডেশন কোর্সের সমমান ধরা হয়েছে। অথচ গুণে-মানে দেশের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবির ওই স্নাতক দেশটির একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, যিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। পেশাজীবীদের এমপ্লয়মেন্ট পাসের জন্য সিঙ্গাপুরে ৪০ নম্বর নির্ধারিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ নম্বর রয়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতায়। ওই স্নাতকের এমপ্লয়মেন্ট পাস নবায়নের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাজ্যের মান অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি স্নাতক সমমানের। আর বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক ডিগ্রি ফাউন্ডেশন কোর্সের সমমানের। এ কারণে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় তিনি কোনো নম্বর পাননি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত স্নাতক সনদকে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ ‘ডিপ্লোমা’ হিসেবে গণ্য করছে। অনেক দেশেই এখন বাংলাদেশের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিকে স্নাতক মানের ধরা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার মান নিম্নমুখী কি না, সেটা জানার জন্যও গবেষণার দরকার। তবে গ্লোবালি শিক্ষাব্যবস্থা খুব বেশি ট্রান্সফর্ম হচ্ছে। এতে অন্য দেশের নীতিনির্ধারকরা যে পদক্ষেপগুলো নিতে পারছেন, আমাদের দেশে তা পারছেন না। এডুকেশন নিয়ে আমাদের কোনো ভিশন নেই, পলিসিরও ঠিক নেই। কারিকুলামও না বুঝে-শুনে পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে আমরা একবার সামনে যাই, আবার পেছনে যাই। কিন্তু আমাদের পাশের দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে, ফলে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এর পরও আমাদের শিক্ষার্থীদের গ্লোবালি পারফরম্যান্স ভালো। কিন্তু সিঙ্গাপুরে যেটা হয়েছে, সেটিও বিবেচনায় রাখা দরকার। আসলে আমাদের সরকার শিক্ষাকে অগ্রাধিকারে রাখছে না।’
সূত্র জানায়, দেশে ২০০৯ সালে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছিল। যদিও ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়, তবে এক বছরের ব্যবধানে তা বাতিল হয়ে যায়। সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল এই ধারণা নিয়ে যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে অনেক বেশি সৃজনশীল হবে। কিন্তু ২০২২ সালের বৈশ্বিক সৃজনশীল ইনডেক্সে ১৩৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৯তম অবস্থানে রয়েছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূচকেও পিছিয়ে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে ইউএনডিপি এবং মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৫৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২০তম। জাতিসংঘের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অরগানাইজেশনের প্রকাশিত ২০২১ সালের বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৬ নম্বরে। উদ্ভাবন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে আছে বাংলাদেশ।
রাজধানীর কিশলয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সদ্য অবসরে যাওয়া অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করতে পারছি না, এ ব্যাপারে আমি একমত। আমাদের শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছে, কিন্তু তাদের পাঠমুখী করতে পারছি না। তারা লাইব্রেরিতে যাচ্ছে না। শিক্ষকরা কতটা প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে আসছেন, কতটা আন্তরিকতা নিয়ে পড়াচ্ছেন, সেটাও ভাবনার বিষয়। আসলে যাঁরা এখন শিক্ষক, তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষক হতে চাননি। ফলে তাঁরা দায়সারা অবস্থায় পাঠদান করাচ্ছেন। উত্কৃষ্ট কারিগর না হলে তো উত্কৃষ্ট শিক্ষা হবে না। এ জন্য শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে মেধাবীদের এ পেশায় আনতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।’
জানা যায়, একসময় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মেডিক্যাল শিক্ষায় বাংলাদেশের সুনাম থাকলেও তা আর ধরে রাখতে পারেনি। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিক্যাল এডুকেশন (ডব্লিউএফএমই) বিশ্বের মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সংস্থাটির অনুমোদন পায়নি। এতে বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশের এমবিবিএস ডিগ্রির গ্রহণযোগ্যতা হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে এর প্রভাব পড়েছে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের বাংলাদেশে এমবিবিএস ভর্তির ক্ষেত্রে। আগে আমাদের পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভুটান ও ভারতের কাশ্মীর থেকে অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী বাংলাদেশে এমবিবিএস পড়তে এলেও এখন তেমন আসছেন না।
চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে স্নাতক ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের করুণ চিত্র উঠে আসে, যা বাংলাদেশের শিক্ষার মানেরই বহিঃপ্রকাশ।
জরিপ অনুসারে, দেশে যত বেকার আছেন, তাঁদের মধ্যে সাড়ে ১৩ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। ৭.১৩ শতাংশ বেকার উচ্চ মাধ্যমিক পাস। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বেকারের একজন ব্যক্তি স্নাতক ডিগ্রিধারী বা উচ্চ মাধ্যমিক সনদধারী।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কোরিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ বেশ কয়েকটি দেশের শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশগুলো তাদের বর্তমান শিক্ষাক্রমে জোর দিচ্ছে বাণিজ্য (অর্থনীতি), বিজ্ঞান (জীববিজ্ঞান), কারিগরি শিক্ষা উন্নয়ন (টিইডি), কৃষি ও বাস্তব দক্ষতা উন্নয়নের মতো বিষয়গুলোয়। আর প্রযুক্তি ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে দেশগুলো নজর দিয়েছে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শেখানোর ওপর। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ধরা হয় ফিনল্যান্ডের বর্তমান ব্যবস্থাকে। বছরে দেশটির একজন অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে অন্তত ৭৪ বার পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা হয়। যদিও সেই মূল্যায়ন আমাদের দেশের গতানুগতিক পরীক্ষা নয়। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুতেই নজর নেই আমাদের নীতিনির্ধারকদের।