
কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের পলাতক স্থানীয় নেতাদের মদদে এখনো চট্টগ্রাম ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড থেকে পণ্য পাচার হচ্ছে। ঝুট-ভাঙারি মালের সঙ্গে বের করে নেওয়া হয় শুল্কমুক্ত সুবিধার পোশাক ও মেশিনের স্পেয়ার পার্টস। পরে সেগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করা হয়। চুরির অর্থের ভাগ পায় ইপিজেড থানা পুলিশ, কাস্টমস কর্মকর্তা ও বেপজার নিরাপত্তাকর্মীরা। এ কাজে ১০টি কারখানা পণ্য পাচারে জড়িত। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ইপিজেডের নিরাপত্তা ব্যবস্থার শিথিলতাই পণ্য পাচারের মূল কারণ উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে কর্মরত দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের অর্থ লিপ্সার কারণে দীর্ঘদিন যাবত এ অনিয়ম চলে আসছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে এই সিন্ডিকেটের কারণে ইপিজেডগুলোতে দুর্বৃত্তদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে যে কোনো সময় এই অবৈধ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে। পণ্য পাচার রোধে তিন দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া; ইপিজেড এলাকার গাড়ি তল্লাশি কার্যক্রম জোরদার করা এবং ইপিজেড ও কেইপিজেডের কাস্টমস আউট গেটে ওজন মাপার স্কেল বসানো যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সোবহান শুক্রবার রাতে মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ, বেপজা ও কাস্টমস আলাদা আলাদা তদন্ত করেছে। পণ্য পাচার রোধে সিইপিজেড তদারকি জোরদার করেছে। তিনি আরও বলেন, প্রায়শই ইপিজেডের গেট থেকে ঘোষণার বেশি ওজনের ট্রাক আটক করে, পরে তা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আন্তঃসংস্থার যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পণ্য পাচার পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রামে অবস্থিত বিভিন্ন ইপিজেডে কারখানায় তৈরি পোশাক, কাপড়, সুতা, জিনস প্যান্ট, জুতা, তাঁবু, খেলনাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদিত হয়। শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি এবং ইপিজেডকেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধার কারণে এখানে উৎপাদিত পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে কম হয়। শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির বিধান থাকলেও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে সংঘবদ্ধ একটি চক্র চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে কোটি কোটি টাকার পণ্য বাইরে নিয়ে আসছে। নানা পথে, নানা পন্থায় এসব পণ্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকার বড় বড় কাপড়ের বাজারে বিক্রি হয়। আগ্রাবাদ এবং জিইসি মোড়ের ফুটপাতের জুতার বিশাল বাজার ছাড়াও নগরীর অভিজাত বিপণি বিতানগুলোতে ইপিজেডের জুতাসহ নানা পণ্য পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে কোটি কোটি টাকার কাপড়সহ নানা পণ্য বেরিয়ে আসলেও ধরা পড়ার পরিসংখ্যান একেবারে নগণ্য। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা কাপড় থেকে শুরু করে নানা ধরনের পণ্য বের হচ্ছে ইপিজেড থেকে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পণ্য পাচারে জড়িত ব্যক্তিরা হলেন-৩৯নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক সুমন, ব্যবসায়ী মোর্শেদুল ইসলাম তাজু। এরা দুজন সিইপিজেড ও কেইপিজেডের বিভিন্ন কারখানা থেকে অবৈধপথে পণ্য পাচার নিয়ন্ত্রণ করে। কারখানা থেকে মাল বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত সবাইকে ম্যানেজ করে থাকে এবং টাকার ভাগাভাগিসহ পুরো প্রক্রিয়ার সমন্বয় করে। চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সহসভাপতি দেবাশিস পাল দেবু, শাহিন চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগের কর্মী শাহেদ চৌধুরী রবিন।
পাচার সিন্ডিকেটের হোতা জিয়াউল হক সুমন ও দেবাশিষ পাল দেবুর মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরে স্থানীয় কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ সিন্ডিকেটের বেশিরভাগ সদস্যই বিদেশে পলাতক আছে।
পণ্য পাচারে জড়িত কারখানাগুলো হলো-জে জে মিলস, প্রিমিয়ার ১৮৮৮, সেকশন সেভেন অ্যাপারেলস, এমএনসি অ্যাপারেলস, মেরিমো, মেরিমো কো. লি., ক্যান পার্ক, রিজেন্সি, প্যাসিফিক ক্যাজুয়াল, এমজেডএম টেক্সটাইল উল্লেখযোগ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবৈধভাবে পণ্য বের করতে পুলিশ, কাস্টমস ও বেপজাকে টাকা দিয়ে হাতে রাখা হয়। সিইপিজেড ও কেইপিজেডের কাস্টমস আউট গেটে বেপজার গোয়েন্দা, পুলিশ ও কাস্টমসের নামে বিভিন্ন গাড়ি হতে নির্দিষ্ট হারে টাকা সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি ঝুটের গাড়ি থেকে পুলিশের জন্য ৩০০ টাকা, কাস্টমসের জন্য ৮০০ টাকা ও বেপজার গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য ৩০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এছাড়া ভাঙারি মালের প্রতিটি গাড়ি থেকে পুলিশের জন্য ১০ হাজার টাকা, কাস্টমসের জন্য ১৫ হাজার টাকা এবং বেপজার গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য ৩ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে এরা গাড়ি সঠিকভাবে চেক না করে ছেড়ে দেয়। ঝুট ও ভাঙারি মালের আড়ালে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অন্য পণ্য বের করে নেয়। এছাড়াও ঝুট ও ভাঙারি মাল কাগজে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বের করে, যার ফলে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়, কাস্টমস ও বেপজার লোকের মাধ্যমে ইপিজেড থানার পুলিশের জন্য কাস্টমস গেটে টাকা উঠানো হয়। পরবর্তীতে সংগৃহীত টাকা ইপিজেড থানার ওসি আক্তারুজ্জামান বিপ্লবের কাছে জমা দেয় এবং তার মাধ্যমে ভাগবাঁটোয়ারা হয়। টাকা সংগ্রহে জড়িত ব্যক্তিরা হলেন-সিইপিজেডে বেপজার গোয়েন্দা রমিজ ও জামির, কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সমীরন সরকার, সাব ইন্সপেক্টর সিরাজ সিপাহী শাহীন। কেইপিজেডের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, গোয়েন্দা পরিদর্শক নজরুল ইসলাম, রাজস্ব কর্মকর্তা আজম উল্লাহ, সিপাহী মাহফুজ, সিপাহী হরি দাস। এসব ব্যক্তিদের সংগৃহীত টাকা পরে বেপজা ও কাস্টমসের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হয়।
জুনে ইপিজেড থানা থেকে বদলি হন আক্তারুজ্জামান বিপ্লব। বর্তমানে তিনি রংপুর রেঞ্জে কর্মরত। ইপিজেডের টাকা ভাগাভাগির বিষয়ে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয় নিয়ে পুলিশ এবং বেপজার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্ত করেছে। বিষয়টি যেভাবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তার সত্যতা পাওয়া যায়নি। আর বর্তমান ওসি জামির হোসেন বলেন, ইপিজেডের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেখানে একটি ফাঁড়ি আছে। ফাঁড়ির পুলিশ পণ্য পাচার রোধে নিয়মিত টহল দেয়।