
উত্তরের ১৬ জেলাসহ দেশে অপরিকল্পিত ও অসম রাসায়নিক সার ব্যবহার করার ফলে মাটির স্বাস্থ্যের (উর্বরা শক্তি) ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে। সর্বনিম্ন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে জৈব পদার্থের উপস্থিতি। এ কারণে মাটিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করলেও তা ফসল উৎপাদনে কাজে লাগছে না। আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ সার ব্যবহারে শুধুই আর্থিক অপচয় হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের সমন্বিত উদ্যোগ।
এমন আশঙ্কাজনক তথ্য পাওয়া গেছে রংপুর বিভাগীয় মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট কার্যালয়ের গবেষণা রিপোর্টে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মাটির স্বাস্থ্য (উর্বরা শক্তি) ক্রমাগত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মাটি হারাচ্ছে নিজস্ব ভারসাম্যতা। এর ফলে মাটির উপৎপাদন ক্ষমতা ক্রমাগত নিম্নগামী হচ্ছে।
মৃত্তিকা গবেষকদের মতে, কৃষক জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ফসলের ফলন পাচ্ছে না। বেড়ে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন ব্যয়। শুধু তাই নয়, মাটির স্বাস্থ্য (উর্বরা শক্তি) নষ্ট হচ্ছে। মাটিতে মিশে থাকা ফসল উৎপাদনের অনুজীবগুলোও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে কৃষিব্যবস্থায় মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের গবেষকরা।
ঢাকার খামারবাড়িতে মৃত্তিকা ভবনে স্থাপিত মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রীয় মাটি পরীক্ষা গবেষণাগারসহ দেশে বর্তমানে ৩৯টি মাটি পরীক্ষার গবেষণাগার রয়েছে। এছাড়া বেশকিছু ভ্রাম্যমাণ মৃক্তিকা গবেষণাগার রয়েছে। এসব গবেষণাগারের তথ্যমতে শুধু রংপুর-রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলা নয়, মাটির উর্বরা শক্তির (গঠন প্রণালিতে মিশ্রিত জৈব, খনিজসহ অন্যান্য উপাদান) উপস্থিতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের মোট খাদ্যশস্যসহ সব ফসল উৎপাদনের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের।
সূত্রমতে, সারা দেশের মাটি নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকাস্থ মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষণা রিপোর্টে এমন তথ্য পেয়েছেন। এজন্য মাটিতে সুষম সার ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। এজন্য ব্যাপক প্রচারণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন মাটি গবেষকরা।
এসব মাটি পরীক্ষাগারে দেশের প্রত্যন্ত জেলা-উপজেলা থেকে মাটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। ওই পরীক্ষা রিপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল ও উপজেলাভিত্তিক মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ‘ভূমি ও মৃত্তিকাসম্পদ ব্যবহারের নির্দেশিকা’ বই প্রকাশ করে আসছে। রংপুর বিভাগের ৫ জেলার ৩৮টি উপজেলা থেকে সংগৃহীত মাটি পরীক্ষা করে রংপুর মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা মাটির স্বাস্থ্যের এই রিপোর্ট দিয়েছেন।
মাঠপর্যায় থেকে রংপুর বিভাগীয় মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের গবেষক দল মাটি পরীক্ষায় দেখছেন, দেশের কৃষি উপযোগী মাটির মারাত্মক রাসায়নিক ও জৈবিক গুণগত পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে, গঠন প্রণালি ভেঙে যাচ্ছে এবং ফসল উৎপাদনের জন্য উর্বরাশক্তি ও ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ভূমিক্ষয় প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। মাঠে অধিক ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ, উৎপাদন কমে যাওয়া, ধানগাছে চিটাসহ নানা প্রকার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, গন্ধক, দস্তা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বোরন, মলিবডেনাম, লৌহ, ম্যাগানিজ, তামা, ক্লোরিন ও জৈব উপাদানসমূহ সঠিক মাত্রায় থাকা দরকার। অর্থাৎ এসব উপাদান ফসল উৎপাদনের জন্য একান্ত অপরিহার্য। তাই মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে এবং মাটির চাহিদা অনুপাতে কৃষকদের জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেমন কৃষক সন্তোষজনক ফলাফল পাবেন। অনুমাননির্ভর সার প্রয়োগের ফলে মাটির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে এবং ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই চিত্র শুধু উত্তরের জেলাগুলোতে নয়, এই আশঙ্কাজনক চিত্র সারা দেশের।
রংপুর বিভাগের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশে অন্তত ২০ প্রকার রাসায়নিক সার বৈধ ও অবৈধভাবে আসছে এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে কৃষকরা ৭টি রাসায়নিক সারের সঙ্গে বেশি পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে ইউরিয়া (নাইট্রোজেন), মলিবডেনাম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, বোরন, পটাশিয়াম ও গন্ধক। এসব সার কৃষকরা অনুমাননির্ভর ব্যবহার করে থাকেন। ফলে পরিমিত পর্যায়ে বা সুষমভাবে মাটিতে সারের প্রয়োগ হচ্ছে না। ওই কৃষিবিদ আরও জানান, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগই শুধু নয়, দেশের অন্যান্য নদী অববাহিকা অঞ্চলের জেলাগুলোতেও একই পরিস্থিতি বিদ্যমান।
গবেষণা রিপোর্টের তথ্য থেকে জানা গেছে, গাছ মাটি থেকে ১৬ প্রকার খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে থাকে। এর মধ্যে ১৩ প্রকার খাদ্য উপাদানই গাছ সংগ্রহ করে মাটি থেকে। গবেষণা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ৯ ধরনের উপাদান মাটিতে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাটিতে জৈব পদার্থের উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন কমপক্ষে শতকরা ৫ ভাগ। বাস্তবে রয়েছে মাত্র শতকরা ১ থেকে ২ ভাগ। মাটিতে পিএইচ (অম্লত্ব) থাকা উচিত কমপক্ষে শতকরা ৬ থেকে সাড়ে ৭ ভাগ। সেখানে রয়েছে শতকরা দশমিক ৪ থেকে সাড়ে ৫ ভাগ। অম্লত্ব কমে গেলে মাটিতে অদ্রবণীয় অদৃশ্য আবরণ তৈরি হয়, ফলে বিশেষ করে টিএসপি (ফসফরাস) সার প্রয়োগ করলে তা উৎপাদিত ফসলের কাজে আসে না। সেটি মাটিতে থাকা ফসল গ্রহণ করতে পারে না। এ কারণে কৃষক কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ফসল পায় না। ফসলের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, এই আমদানিনির্ভর সারের প্রয়োগ বেশি মাত্রায় দিতে গিয়ে টিএসপি সারের চাহিদা বেড়ে যায়। যা ফসলের জমিতে প্রয়োগ করলেও কাজে আসে না। যেখানে মাটিতে নাইট্রোজেন থাকা উচিত শতকরা শূন্য দশমিক ২৭ থেকে শূন্য দশমিক ৩৬ ভাগ, সেখানে রয়েছে মাত্র শতকরা দশমিক ০৯ থেকে শূন্য দশমিক ১৮ মাত্রা পর্যন্ত। একইভাবে সালফার থাকা প্রয়োজন শতকরা ২২ দশমিক শূন্য ৫ থেকে ৩০ পর্যন্ত। সে মাত্রাও সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমানের মতে, মাটিতে পোকামাকড়ের জীবনচক্রের সঙ্গে অতিরিক্ত জৈব পদার্থ সংযুক্ত রয়েছে। যেমন কেঁচো মাটি খেয়ে ওপরের স্তরের মাটি নিচে ও নিচের স্তরের মাটি ওপরে আনে। যা কৃষকের জন্য সুফল বয়ে আনে। বাংলাদেশে প্রায় ২০ প্রজাতির ব্যাঙ রয়েছে, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ব্যাঙের বংশ বৃদ্ধি কমেছে। এছাড়া এখন গবাদিপশুর বর্জ্য এবং বিভিন্ন গাছপালা পচনের পর যে জৈব উপাদান মাটিতে এক সময় কৃষকরা ব্যবহার করত। তা এখন ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে মাটিতে জৈব উপাদান ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। এখন কৃষি জমির মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজন অনুপাতে সার ব্যবহারে কৃষকদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া জরুরি। এর ফলে দেশে রাসায়নিক সারের যে ঘাটতি তা মোকাবিলা করা সম্ভব। তা না হলে দেশের কৃষিব্যবস্থার জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।