
দেশে প্রতিদিন প্রায় অর্ধলাখ মানুষ নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন । কারও আঘাত মৃদু , কারও মাঝারি , আবার কারও আঘাত মারাত্মক হয় । মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০০ জন আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন , আর মারা যান আড়াই শতাধিক । আঘাতের কারণে যাঁরা মারা যান তাঁদের অর্ধেকেরই মৃত্যুর কারণ তিনটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা । আর তা হলো আত্মহত্যা , পানিতে ডুবে মৃত্যু এবং পড়ে গিয়ে মৃত্যু । সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় , স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ , বাংলাদেশ ( সিআইপিআরবি ) পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে ।
গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘ প্রিভেলেন্স অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস ফর মর্টালিটি অ্যান্ড মোরবিডিটি ইন রিলেশন টু ন্যাশনাল হেলথ ইনজুরি সার্ভে অব বাংলাদেশ ২০২২-২৩ ' শিরোনামে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে । গবেষণায় যেসব অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা উঠে এসেছে , তা সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান থাকলেও এসব সমস্যা রোধে প্রয়োজনীয় মনোযোগ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা । ফলে এসব সমস্যা স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ যেমন সৃষ্টি করছে , তেমনি বেড়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যয় । এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষ চিরতরে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন এসব কারণে ।
গবেষণায় বলা হয়েছে , দেশে প্রতিবছর ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি মানুষ নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন । সে হিসাবে দৈনিক ৪৫ হাজারের বেশি মানুষ আঘাত পান । মারাত্মক আঘাতে বছরে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যান । অর্থাৎ দৈনিক মারা যান গড়ে ২৬৮ জন । একইভাবে প্রতিবছর ১ লাখ ৩৮ হাজারের বেশি এবং দৈনিক ৩৮০ জন আজীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন । মারাত্মক আঘাতে প্ৰাণ হারানোদের মধ্যে প্রতিবছর সাড়ে ২০ হাজারই আত্মহত্যার কারণে মারা যান , যার দৈনিক গড় ৫৬ জন । এ ছাড়া পানিতে ডুবে মারা যান বছরে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ , দৈনিক গড়ে ৫০ জন । গাছ বা অন্যান্য উঁচু স্থান থেকে পড়ে বছরে সোয়া ১৪ হাজার এবং দিনে গড়ে ৩৯ জন মানুষ মারা যান । এ ছাড়া যন্ত্রপাতির আঘাত , ধারালো বস্তুতে কেটে যাওয়া , দুর্ঘটনার কারণে শ্বাসরোধ , দগ্ধ হওয়া , ভোঁতা বস্তুর আঘাত , প্রাণী বা কীটপতঙ্গের কামড় , সহিংসতা , বিদ্যুতায়িত হওয়া এবং সড়ক দুর্ঘটনার কারণেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে । সব মিলিয়ে এই ১২ ধরনের আঘাতের কারণে দেশে প্রতিবছর মোট ৯৮ হাজার ৪২২ জন মানুষ মারা যান ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিআইপিআরবির গবেষণায় উঠে আসা যে বিষয়টি আলাদা করে উল্লেখ করার মতো তা হলো , আঘাতের কারণে দৈনিক মোট মৃত্যুর ৫৪ শতাংশেরই কারণ আত্মহত্যা , পানিতে ডুবে যাওয়া এবং উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া । এই তিন কারণে সৃষ্ট আঘাতে দিনে গড়ে ১৪৫ জন মানুষ মারা যান । এসব বিষয়কে অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( ডব্লিউএইচও ) , আন্তর্জাতিক ও দেশীয় স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো । জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন , আত্মহত্যা , পানিতে ডুবে মৃত্যু এবং পড়ে যাওয়া — এই তিনটি স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য ।
তবে গবেষণা , নীতি ও অর্থায়নে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় এগুলোকে অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা হয় । এ ছাড়া থেলাসেমিয়া , কুষ্ঠরোগ , সাপের দংশনসহ বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগকেও এভাবে বিবেচনা করা হয় । এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো . সাইদুর রহমান বলেন , “ অসংক্রামক রোগ ও অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ে ৩৫ টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে । সরকার ইতিমধ্যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়েছে এবং পানিতে ডুবে মৃত্যু , আত্মহত্যা ইত্যাদির মতো সমস্যাগুলো চিহ্নিত করছে । এসব সমস্যায় প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম এখনো সীমিত ।
এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ চলছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতাও নেওয়া হয়েছে । ডব্লিউএইচওর ২০১০ , ২০২১ ও ২০২৩ সালের তিনটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে , কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সমস্যা এখনো অবহেলিত রয়ে গেছে । সংস্থাটির ভাষায় , অবহেলাজনিত জনস্বাস্থ্য সমস্যা হলো এমন সমস্যা , যা মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যে গভীর প্রভাব ফেলে । কিন্তু বৈশ্বিক ও জাতীয় নীতি , গবেষণা , অর্থায়ন কিংবা প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপে তা যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না । অনেক সময় এসব সমস্যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আলোচনায়ও স্থান পায় না । আক্রান্ত জনগোষ্ঠী সাধারণত দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণির হওয়ায় তাদের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শোনা যায় না । তা ছাড়া সামাজিক কলঙ্ক , রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায় ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে , আত্মহত্যায় বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর সোয়া ৭ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে । এটি ১৫ - ২৯ বছর বয়সী তরুণদের মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর একটি । তবে সামাজিক কলঙ্ক , আইনি জটিলতার কারণে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও নীতি - উদ্যোগ সীমিত থেকে যাচ্ছে । অন্যদিকে , পানিতে ডুবে মৃত্যু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা । প্রতিবছর এ কারণে মারা যান ৩ লাখ মানুষ । বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণও এটি । সাঁতার শেখানো কিংবা পানিতে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের মতো কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নীতি পর্যায়ে এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না । একইভাবে উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া বা ফ্যালস বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান অনিচ্ছাকৃত আঘাতই মৃত্যুর কারণ । প্রতিবছর ৬ লাখ ৮৪ হাজার মানুষ এ ধরনের আঘাতে প্রাণ হারান ।
বিশেষত বয়স্কদের জন্য এটি বড় ঝুঁকি হলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও বিনিয়োগ এখনো সীমিত । আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বড়সংখ্যক মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষাধিক মানুষ আজীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়াটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড . শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন , “ অবহেলিত জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ে দেশে কাজ কম । এ বিষয়ে রেফারেন্স বা প্রমাণও সীমিত । ফলে সরকারের মনোযোগও কম । দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন খরচসাপেক্ষ এবং ফলও দ্রুত পাওয়া যায় না , তাই অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না । আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা মূলত চিকিৎসাকেন্দ্রিক । যাঁরা আঘাতপ্রাপ্ত বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন , তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ । । ফলে তাঁদের সমস্যাকে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয় না । ’
সিআইপিআরবির পরিচালক অধ্যাপক ড . এ কে এম ফজলুর রহমান বলেন , আঘাতজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে তাঁদের গবেষণা প্রতিবেদনটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে । গবেষণা জরিপে দেখা গেছে , পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা কমলেও , আত্মহত্যা বেড়েছে । এসব সমস্যা ‘ অবহেলিত ’ হিসেবে ধরা হয় , কারণ এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা বা কার্যক্রম নেই । তিনি বলেন , ‘ সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে , তবে অন্য ক্ষেত্রগুলোতে তা হয়নি । ক্ষতির মুখে পড়ছে প্রধানত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী । এসব আঘাত এবং মৃত্যু প্রায় অদৃশ্য বা ‘ ইনভিজিবল ইনজুরি অ্যান্ড ডেথ ' হিসেবে রয়ে যাচ্ছে । '
ওই গবেষণাটিতে বহুধাপী ক্লাস্টার নমুনা গ্রহণ পদ্ধতি ( মাল্টিস্টেজ ক্লাস্টার ) স্যাম্পলিং ) ব্যবহার করা হয়েছে । গ্রামীণ ও শহরভিত্তিক স্তরীকরণ করা হয় এবং দেশের সব ৬৪ জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয় । জরিপে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ( বিবিএস ) কর্তৃক সদ্য উন্নত প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট ( পিএসইউ ) ব্যবহার করা হয়েছে । এতে মোট ৪ লাখ ৩৯ হাজারের বেশি মানুষের ( প্রায় সোয়া এক লাখ পরিবার ) তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । গবেষণায় দেখা গেছে , আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ মানুষ ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানে যান । উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যায় ১৫ শতাংশ , বেসরকারি হাসপাতালে ৯ শতাংশ , জেলা হাসপাতালে ৯ শতাংশ , চিকিৎসকের চেম্বারে শতাংশ , বিশেষায়িত হাসপাতালে ৪ শতাংশ । কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে যায় মাত্র ১ শতাংশ ।
পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ( ইলেকট ) অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন , “ আত্মহত্যা , পানিতে ডুবে মৃত্যু এবং উঁচু থেকে পড়ে যাওয়া নেগলেকটেড পাবলিক হেলথ ইস্যু , কারণ এগুলো সাধারণ মৃত্যুর তুলনায় ব্যতিক্রম এবং যথেষ্ট আলোচনায় আসে না । তথ্যও সঠিকভাবে রিপোর্ট হয় না । গবেষণার ফলে আমরা জানতে পেরেছি কত মানুষ আহত , পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা মারা যান । এখন এই গবেষণার ফল ব্যবহার করে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে । '