
দেশের পেট্রোলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনগুলোয় একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটায় স্পর্শকাতর এসব স্থাপনার নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। সঠিকভাবে নিয়ম মেনে পেট্রোলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনগুলো পরিচালিত না হওয়ায় দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে, হচ্ছে জানমালের ক্ষতি। রাজধানীর ব্যস্ততম মহাখালীর পেট্রোলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনগুলো দুর্ঘটনার হটস্পটে পরিণত হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে মহাখালীতেই দুটি পেট্রোলপাম্পে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ২০২৩ সালেও মহাখালীর আরেক পেট্রোলপাম্পে অগ্নিকা ঘটে।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ফিলিং স্টেশনে ৩০টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। আর দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, পাম্প ও স্টেশনে সিগারেট ধরানো, গ্যাসের লিকেজ, পাম্পের ভিতর ত্রুটিপূর্ণ গ্যাসলাইন এবং ট্যাংকারে জমে থাকা গ্যাস থেকে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। দেশের পেট্রোলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনগুলো দীর্ঘদিন ধরে নিয়মকানুন অমান্য করে চলেছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও নিয়মনীতি না মানার কারণে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। মূলত পুরোনো সরঞ্জাম, নিরাপত্তাবিধি লঙ্ঘন, নিয়মিত পরিদর্শনের অভাবে পেট্রোলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনগুলোয় দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিএনজি বিধিমালা ২০০৫ অনুসারে, প্রতিটি স্টেশনে লাইসেন্সধারীর নাম, লাইসেন্স নম্বরসহ বিপজ্জনক পদার্থ সম্পর্কিত জাতিসংঘ-প্রস্তাবিত সুরক্ষা লেবেল প্রদর্শন করতে হবে। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ নিষিদ্ধ ও সুরক্ষা এবং পরিচালন সরঞ্জামগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ বাধ্যতামূলক। প্রতি দুই বছর পর যোগ্য কর্মীদের দিয়ে সমস্ত সরঞ্জাম পরিদর্শন করতে হবে। এ ছাড়া স্টেশনে ধূমপান করা যাবে না এবং দিয়াশলাই, আগুন, বাতি আনা যাবে না। কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ স্টেশন এ নিয়মগুলো মানছে না। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আসাদুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পেট্রোলপাম্পে যে ট্যাংকলরিগুলো জ্বালানি পরিবহন করে তা ব্যবহার উপযোগী কি না দেখতে হবে। এ-সংশ্লিষ্ট বিধিমালায় যে নির্দেশনা আছে সেগুলো ঠিকভাবে মানা হয় না। দাহ্য পদার্থের ক্ষেত্রে মজুত, সংরক্ষণ, ব্যবহার, সরবরাহ সব ক্ষেত্রে নির্দেশনা আছে। তেল নামানোর সময় সিএনজি স্টেশন ও পেট্রোলপাম্প বন্ধ রাখা ভালো। কারণ তেল নামানোর সময় সেখানে আগুন লাগার যথেষ্ট ঝুঁকি তৈরি হয়। সারা দেশে বিস্ফোরক পরিদর্শক আছেন মাত্র ১৫ জন। এ স্বল্পজনবল দিয়েই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের পরিদর্শনে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ঢাকার সিএনজি স্টেশনগুলোয় ক্যাসকেড স্টোরেজ সিলিন্ডারে মরিচা পাওয়া গেছে, যা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পরীক্ষা করার কথা, কিন্তু তা করা হয়নি। পরিবর্তে নিরাপত্তা নিয়ম লঙ্ঘন করে এ সিলিন্ডারগুলোয় সিএনজি সংরক্ষণ করা হয়েছিল, যা বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি করে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, স্টেশনগুলো নিয়মকানুন উপেক্ষা করে কাজ করছে এবং পর্যবেক্ষণ মূলত ভাসাভাসা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘অতি উচ্চ দাহ্য পদার্থ যে স্থানে পরিবহন, ফিলিং-রিফিলিং ও মজুত করা হচ্ছে সেগুলো খুবই বিপজ্জনক জোন। সব সংস্থা পরিচালনার জন্য বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু যাদের জন্য এ বিধি, তারা তা কঠোরভাবে মানলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না। প্রতিটি সংস্থার পরিদর্শক আছেন, তাঁরা যদি সচেতনভাবে এসব স্থান পরিদর্শন করে সঠিক প্রতিবেদন দিতেন তাহলে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানতে পারতেন। অনেক সময় পেট্রোলপাম্প ও সিএনজি স্টেশনের মালিকদের একটি পাসের জন্য অনেক স্থানে দৌড়াতে হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এটি সহজ করা দরকার। অনেক সংস্থার বিধিনিষেধ থাকলেও তা রেগুলেশনের জন্য কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ নেই। এতে অসৎ মালিকরা অনিয়ম করার সুযোগ পেয়ে যান। আন্তমন্ত্রণালয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দুই-তিনটি সংস্থা মিলে এ বিষয়গুলোর তদারকি করতে পারে।’
মহাখালীর গুলশান সার্ভিস সেন্টার নামে একটি পেট্রোলপাম্পে অগ্নিকান্ডে ২৩ সেপ্টেম্বর সাতজন দগ্ধ হন। পাম্পের এক কর্মীর ভাষ্যে, পাম্পের তেল রাখার খালি ট্যাংক পরিষ্কার করতে মঙ্গলবার তিনজন এসেছিলেন। দুপুরে কাজ করার সময় ট্যাংকে জমে থাকা গ্যাসে আগুন লাগে। এতে তিনজন দগ্ধ হন। এর আগে ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় মহাখালীর ইউরেকা পেট্রোলপাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকা ঘটে। ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর মহাখালী বাস টার্মিনালের কাছে রয়েল পেট্রোলপাম্পে অগ্নিকাণ্ডে আটজন দগ্ধ হন। পাম্পের কর্মচারীরা জানান, রাতে কাজ করার সময় পাম্পের ভিতর মূল গ্যাসপাইপে বিকট বিস্ফোরণ হয়। এতে আশপাশের লোকজন দগ্ধ হন। সেখানে গ্যাসের লাইন মেরামতের কাজ চলছিল। ২০২৪-এর ১০ জানুয়ারি পাবনার একটি পাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকা ঘটে। পাবনা শহরের রাধানগরের ফরিদ ফিলিং স্টেশনে জ্বালানিবাহী একটি গাড়ির তেল খালাসের সময় পাম্পের এক কর্মচারী সিগারেট ধরালে এ দুর্ঘটনা ঘটে।