
নানা সংকটের বেড়াজালে আটকে দৃষ্টিনন্দন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালটি চালু নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ বিমান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে না পারায় টার্মিনালটি চালু হওয়ার বিষয়ে গভীর সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টার্মিনালটির কাজ ৯৯ শতাংশ শেষ। কিন্তু সংকট না কাটাতে পারায় সেটি চালু করতে পারছে না বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শেষ মুহূর্তে টার্মিনালের অপারেশনের জন্য নির্ধারিত জাপানি ছয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তায় এ সংকটে পড়েছে বেবিচক। জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু কঠিন শর্তের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় বিকল্প কোম্পানির খোঁজ করছে মন্ত্রণালয়।
অপরদিকে টার্মিনালে অতিরিক্ত কাজ বাবদ কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্যামসাং বাড়তি টাকা দাবি করেছে, যা পরিশোধ করা নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ে টার্মিনালটি চালু হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর ফলে টার্মিনালে স্থাপিত যন্ত্রপাতি অলস পড়ে থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হচ্ছে এবং কিছু যন্ত্রাংশ কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনায় শুরু থেকেই জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে আসছিল বেবিচক। জাপানের দুটি সরকারি ও চারটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত একটি ‘বিশেষায়িত কোম্পানি’ আগামী ১৫ বছরের জন্য টার্মিনালটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আলোচনা করেছিল। তবে বেবিচক কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছু কঠিন শর্ত জুড়ে দিলে প্রক্রিয়া জটিল আকার ধারণ করে।
এমন অবস্থায় বিকল্প অপারেটর খোঁজার ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। প্রয়োজনে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া শুরুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
IMG_0646-5fa6d54253af131ff780e49975bd1ba7-2012a26033c858aedac934398f56c89dশাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)
বেবিচকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রতিষ্ঠানগুলোর শর্তের মধ্যে রয়েছে থার্ড টার্মিনালের দোকানপাট ও লাউঞ্জ নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং চার্জ, বিলবোর্ড, বিভিন্ন অফিসের ভাড়া, বিমানের ল্যান্ডিং চার্জ, যাত্রী ভ্রমণ চার্জ, নিরাপত্তা চার্জসহ নানা ধরনের চার্জ বাড়ানো। এই চার্জ বৃদ্ধিসহ আরও যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো ‘অবাস্তব’ বলে আখ্যা দেন তিনি।
এই কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব শর্ত দিয়েছে তা কিছুতেই মানা সম্ভব নয়। তারা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। তাহলে আমাদের কাজটা কী হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৈঠকে আমাদের সবাই শর্তগুলোর বিরোধিতা করেছে। আমরা এখন অন্য কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবো। পাশাপাশি জাপানের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাবো।’
জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর শর্তের পাশাপাশি ঠিকাদারি কোম্পানির পাওনা পরিশোধ নিয়েও সংকটে পড়েছে বেবিচক। এ প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘কোরিয়ান স্যামসাং কোম্পানির পাওনা নিয়ে আমরা বিপাকে পড়েছি। পাওনা অর্থের পরিমাণ অনেক। এই অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। কোম্পানির সঙ্গেও আলোচনা চলছে।’
জানা গেছে, কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্যামসাং দাবি করেছে, বেবিচকে চাহিদা অনুযায়ী তৃতীয় টার্মিনালে অতিরিক্ত ৬০৫টি কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বাবদ চুক্তির চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় এক হাজার কোটি টাকা দাবি করেছে তারা। কিন্তু বেবিচক এ অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পাওনা পরিশোধের নোটিশ দিয়ে গত ১৫ আগস্ট চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এ দফায় অর্থ পরিশোধ না হলে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা হবে বলেও চিঠিতে হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে, টার্মিনালের সর্বশেষ প্রস্তুতি ও ইমিগ্রেশনের অবস্থা দেখতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি টার্মিনাল পরিদর্শন করেছে বলে জানা গেছে। সূত্র জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা থার্ড টার্মিনালের প্রস্তুতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। পরিদর্শনকালে বেবিচকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে স্থাপিত কিছু যন্ত্রপাতিশাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে স্থাপিত কিছু যন্ত্রপাতি
অন্যদিকে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন এবং সচিব নাসরিন জাহান থার্ড টার্মিনালের বিষয়ে কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। সচিব বলেন, তারাও নির্দিষ্ট করে জানেন না কবে চালু হতে পারে থার্ড টার্মিনাল।
সচিব নাসরিন জাহান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানের একটা বিমানবন্দর চালুর জন্য সব প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় দরকার। এ জন্য যত রকম করণীয় আছে, তার সব করা হয়েছে। তবে এখনও অপারেশন মেইনটেনেন্সের অংশ, যেটি এভিয়েশনের প্রাণ—ওই কাজটি চলমান আছে। সেটি শেষ হয়ে যখন আমাদের ক্লিয়ারেন্স দেবে, ইমিডিয়েটলি আমরা সেটা চালু করবো। যখন পুরোদমে রেডি হবে তখনই কেবল ঘোষণা দেওয়া যায়।’
উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ‘এই প্রসেস কমপ্লিট করার জন্য দুটি ধাপ। প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে আমাদের একটি অপারেটর নির্বাচন, যে বিষয়ে সচিব আপনাদের বলেছেন। সেই বিষয়ে আমরা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। অপারেটর সিলেকশনের পর অপারেশন রেডিনেস টেস্ট, এটার জন্য আমাদের কয়েক মাস সময় লাগবে। এ বিষয়ে যারা পরামর্শক আছেন, তারা যখন রেডিনেস টেস্ট কমপ্লিট করবেন তখন আমাদের বিমানবন্দর চালু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি চালু করার বিষয়ে আমাদের প্রচেষ্টার কোনও শেষ নেই। কারণ এখানে আমাদের ২১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এখানে বিনিয়োগ আমরা করেছি, জাপানিরা করেনি। এই খরচ মেটানোর জন্য যত দ্রুত আমরা চালু করতে পারি। এটা শুধু আমাদের যাত্রী পরিবহনের সেবার উন্নতিকরণ না, এখানে আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থও জড়িত। আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সিভিল এভিয়েশন থেকে সবাই একসঙ্গে চেষ্টা করছি, যত দ্রুত করা যায়।’
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ১৩৯৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। নির্মাণকাজে অর্থায়ন করছে জাইকা। জাপানের নির্মাতা কোম্পানি সিমুজি ও কোরিয়ার স্যামস্যাং নামের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) নামে যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।