
জুলাই আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতার ওপর এলএমজি, এসএমজি, চাইনিজ রাইফেল, শটগান, রিভলবার ও পিস্তল দিয়ে গুলি করে পুলিশ। এছাড়া আন্দোলন দমাতে সারা দেশে ৩ লাখ ৫ হাজারেরও বেশি রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় তা ছাড়িয়ে যায় ৯০ হাজার রাউন্ডেরও বেশি। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের দেয়া ২১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য তুলে ধরেন মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. আলমগীর।
সোমবার বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি এই জবানবন্দি দেন। জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৫৪তম সাক্ষী হিসেবে মো. আলমগীর এসব তথ্য উপস্থাপন করেন। গতকাল তিনি এ মামলায় দ্বিতীয়দিনের মতো সাক্ষ্যর জবানবন্দি দিয়েছেন। আলমগীরের পরবর্তী জবানবন্দি ও আসামিপক্ষের জেরার জন্য আজ মঙ্গলবার দিন ধার্য করেছেন আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর বলেন, মামলার তদন্তকালে সংগৃহীত আলামত, পত্রপত্রিকা, ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, বই, বিশেষজ্ঞ মতামত, বিভিন্ন প্রতিবেদন, শহীদ পরিবারের সদস্য, আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান তথা ‘জুলাই ৩৬’-এর সময় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পরিকল্পিতভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছে।’
আলমগীর আরও জানান, ২০২৪ সালের ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে নিরীহ, নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হাজার হাজার মানুষকে গুরুতর জখম ও অঙ্গহানি, নির্বিচারে আটক, নির্যাতন, অপহরণ, মিথ্যা মামলা দায়ের, জীবিত ও মৃত ব্যক্তিকে পুড়িয়ে দেয়া, চিকিৎসা ও জানাজা-দাফনে বাধা, মৃত্যুর প্রকৃত কারণ পরিবর্তনে বাধ্য করা, নিহতদের মরদেহ পরিবারকে না দিয়ে বেওয়ারিশ পরিচয়ে তড়িঘড়ি করে দাফন, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়, হাসপাতালে আহতদের ওপর পুনরায় হামলা এবং আন্দোলনরত ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়।
ইনুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি ১৪ই অক্টোবর: জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে কুষ্টিয়ায় ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানির জন্য আগামী ১৪ই অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ দেন। এদিন, ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। তিনি আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগের ওপর শুনানির জন্য এক সপ্তাহ সময় চান প্রসিকিউশন। অন্যদিকে, আসামি ইনুর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী নাজনীন নাহার। তিনি শুনানির জন্য আরও দু’দিন বাড়িয়ে সময়ের আবেদন করলে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আগামী ১৪ই অক্টোবর দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে, গত ২৫শে সেপ্টেম্বর ইনুর বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় সহযোগিতাসহ সুনির্দিষ্ট আটটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। এরপর শুনানি শেষে অভিযোগ আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেন ট্রাইব্যুনাল-২।
উত্তরায় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ২ আওয়ামী লীগ নেতাকে হাজিরের নির্দেশ: জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত রাজধানী উত্তরায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট মূলে আগামী ২২শে অক্টোবর তাদের হাজিরের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। এরা হলেন- মো. সোহেল রানা ও মো. শাহ আলম। তারা দু’জনই সম্প্রতি কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের মিটিং-মিছিলে যেয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গত ২৫শে সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন তারা। এর মধ্যে সোহেলের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানায় ও শাহ আলমের নামে তেজগাঁও থানায় মামলা রয়েছে। তবে দু’জনই জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তরায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের এ মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যুর জন্য আবেদন করা হয়। এর আগে, গত ২৩রা সেপ্টেম্বর এ মামলায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে আগামী ২২শে অক্টোবরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
শিবির নেতাকে গুলির ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি: যশোরের চৌগাছায় গ্রেপ্তারের পর বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে ছাত্রশিবিরের দুই নেতাকে গুলি করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় উপ-পরিদর্শক (এসআই) আকিকুল ইসলামসহ তিন পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলায় গ্রেপ্তার অন্য দু’জন হলেন- চৌগাছা থানার তৎকালীন কনস্টেবল সাজ্জাদুর রহমান ও কনস্টেবল জহুরুল হক। এদিন, প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পাহ্লোয়ান মামলায় গ্রেপ্তার তিন আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাদের আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।